ভৈরবে কয়লার ব্যবসা, হুমকির মুখে কেপিআই এলাকা
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার পুরাতন ফেরিঘাট এলাকা থেকে শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতুর নিচ পর্যন্ত হাজার হাজার টন কয়লা রেখে ব্যবসা করা হচ্ছে। এতে এখানকার পরিবেশের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। যেকোনো সময় কয়লার স্তূপে আগুন লাগলে এখানকার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কেপিআই) ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।
এরই মধ্যে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতু রক্ষায় নদীর তীর ঘেঁষে রোপন করা শত শত গাছ কয়লার তেজষ্ক্রিয়তায় মরে গেছে। ছায়াবিথী অঞ্চলটি পরিণত হয়েছে খাঁ খাঁ বিরাণ ভূমিতে।
অন্যদিকে কয়লার ধূলি-কণা ও কার্বণের কারণে এলাকার পরিবেশের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। কয়লার ধূলি-কণা বাতাসে মিশে পরিবেশকে করে তুলেছে দূষণীয়। সেই ধূলি-কণা মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত করছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এখানকার লোকজন এক সময় ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা চিকিৎসকের।
স্থানীয় লোকজন জানায়, ভৈরবের মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত দুটি রেলসেতু ও একটি সড়ক সেতুর নিচে স্থানীয় লোকজনসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ভ্রমণ পিপাসু মানুষের আসা-যাওয়ায় এলাকাটি একটি অলিখিত বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন এবং বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে পরিবার-পরিজন নিয়ে মনোরঞ্জনের জন্য এখানে আসেন লোকজন।
কিন্তু চার-পাঁচ বছর ধরে একটি প্রভাবশালী মহল এখানকার পুরো এলাকাটিতে কয়লা রেখে ব্যবসা করছেন। নদীপথে লাইটারেজ জাহাজ ও বলগেটে করে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা কয়লা এনে এখানে স্তূপ করে রাখে। এরপর ট্রাকে করে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে থাকেন ব্যবসায়ীরা।
ভৈরব প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান বাচ্চু ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম রিপন জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি কয়লাভর্তি শত শত ট্রাকের যাতায়াতে পুরাতন ফেরিঘাট এলাকা থেকে শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতুর নিচ পর্যন্ত এলাকা হয়ে ওঠে ধূলিময়।
হাজার হাজার শ্রমিকের হৈ-হুল্লোরে প্রকৃতির শান্ত-নীরব এলাকাটি পরিণত হয়েছে একটি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ ও শব্দদূষণ এলাকায়। শহুরে নাগরিক জীবনে এতোটুকু নির্মল সতেজ বাতাস নিঃশ্বাস ভরে নিতে লোকজন এখানে আসে প্রতিদিন। কিন্তু সুস্থতার জন্য এসে এখন অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তারা এই অবস্থার দ্রুত অবসান চান।
ইউসুফ বাবু মডেল টাউনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বশির আহমেদ বিপ্লব অভিযোগ করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এলাকাটিতে একটি বিনোদন কেন্দ্র করার বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিলে সেটি ফিরিয়ে দেওয়া হয় কেপিআই এলাকা হওয়ায়। অথচ বর্তমানে কয়লার মতো একটি দাহ্য পদার্থ রেখে দিনের দিন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল।
এলাকায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ছাড়াও রয়েছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল কোম্পানির ডিপো। প্রতিদিন এখান থেকে দেশের আটটিরও বেশি জেলায় ট্যাংকলরির মাধ্যমে তেল সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়াও এখানে তিতাস গ্যাসের সরবরাহ লাইনের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে।
ভৈরব এবিসি স্কুলের অধ্যক্ষ কামাল পাশা আশঙ্কা করে বলেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস-তিনটিই দাহ্য পদার্থ। স্তূপ থাকা কয়লায় রোদের তাপে প্রায়ই আগুন ধরে যায়। তখন কয়লার স্তূপের আগুন-ধোয়ায় এলাকাটিতে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই আগুন যদি কখনো তেল বা গ্যাসের সংযোগে ধরে যায়, তখন আশেপাশের কয়েক মাইল এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ। মারাত্মক ক্ষতি হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের।
এদিকে এখানে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ণরত দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে বলে জানালেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক এম.এ.আব্দুল মান্নান। তাঁর অভিযোগ, কয়লার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও এখানকার রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দারা শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলেও তাঁর দাবি। তিনি অবিলম্বে এ থেকে পরিত্রাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের যথাযথ পদক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. কেএনএম জাহাঙ্গীর জানান, কয়লা একটি দাহ্য পদার্থ। এর ধূলি-বালু ও কার্বন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ভেতরে গিয়ে ফুসফুসে জমা হয়ে স্থায়ী শ্বাসকষ্টসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত করতে পারে লোকজনকে।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ এমন স্থানে কেনো তারা কয়লার মতো একটি ক্ষতিকর জ্বালানি মজুদ করে ব্যবসা করছেন, এমন প্রশ্ন করা হলে ভৈরব কয়লা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজনু সওদাগর হাসান জানান, কয়লা রাখার মতো বিকল্প স্থান তারা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে এখানে কয়লা রাখছেন। তিনি জানান, প্রশাসনসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যকে তাদের সমস্যাটি জানানো হয়েছে।
ফেরিঘাটের জেটি এলাকা থেকে কালিপুর নদীর তীর পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করে দিলে তারা কয়লার আড়তটি নিয়ে ওখানে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারবেন। তখন এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন মজনু সওদাগর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত সাদমীন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি শুনেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।