‘প্রতিমন্ত্রী না হলে বাবরের এ বিপদ আসত না’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী এস এম শাহজাহান যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, কোনো জনমে পাপ করেছিলেন হয়তো তার জন্য লুৎফুজ্জামান বাবর হঠাৎ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হলেন। অন্যথায় তাঁর এমন বড় বিপদ আসত না। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষটাও তাঁর কপালে জুটল না।’
শাহজাহান বলেন, ‘উনি তো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ক্ষমতা থাকা অবস্থায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বসিয়ে তিন মাসে বিচার শেষ করতেন। যা আমাদের দেশে এখন চলছে। তখন তো তিনি চাইলে নিজে বেঁচে যেতেন। মামলাও শেষ হয়ে যেত।’
আজ মঙ্গলবার পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দীনের আদালতে মামলা চলাকালে এসব যুক্তি তুলে ধরেন এস এম শাহজাহান।
পরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
আজ বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন তাঁর আইনজীবী এস এম শাহজাহান। এর আগে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বাবরসহ আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। আজ গ্রেনেড হামলা মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শেষ দিন বলে জানানো হয়েছিল। দুপুর সোয়া ২টায় মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, ‘এ মামলার এজাহারে বাবরের নাম ছিল না। প্রথম চার্জশিটেও তাঁর নাম ছিল না। মামলার চার্জশিট দেওয়ার সময় তিনি ক্ষমতায়ও ছিলেন না। বরং কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতায় ছিল। তখন নিরপেক্ষ চার্জশিট দেওয়ার পর তাঁর নাম নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁর নাম যুক্ত করে। এ মামলায় সাক্ষ্য আইন লঙ্ঘন করে ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর পুনরায় তদন্ত করা হয়েছে। যার কোনো বৈধতা নেই।’
শাহজাহান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী অধিকতর তদন্ত করা হয় মামলার পর যেসব আসামি অজ্ঞাত বা হদিস নেই তাঁদের বিষয়ে। কিন্তু এখানে লুৎফুজ্জামান বাবর সাহেব একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী। পুনর্তদন্তের আগে এ মামলায় ৬১ জন সাক্ষী দিয়েছেন তখন কোনো সাক্ষী লুৎফুজ্জামান বাবর সাহেবের নাম বলেননি। আমার সামনে দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত রয়েছেন। কিন্তু এ মামলায় যে তদন্ত হয়েছে তা হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই নেই। যদি তদন্ত ভালোভাবে না হয় প্রসিকিউটরের কী করার আছে?’
এ সময় প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিষয়ে বলতে হবে না আপনি আসামির বিষয়ে বলেন।’
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, ‘মুফতি হান্নান প্রথম দোষ স্বীকারে লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম উল্লেখ করেনি। কিন্তু মামলার পর লুৎফুজ্জামান বাবর ক্ষমতায় থাকাকালীন মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করে দশবার রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর ওয়ান ইলেভেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিলেন কিন্তু তখনো বাবরের নাম উল্লেখ করেননি। হাওয়া ভবন বা আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায় বৈঠকের বিষয়ে তো মুফতি হান্নান প্রথম জবানবন্দিতে কোনো স্বীকারোক্তিই দেননি। বরং কোনো মামলায় সাক্ষ্য নেওয়ার পর পুনরায় তদন্ত করার বৈধতা নেই।’
শাহজাহান আরো বলেন, ‘আমি বলব এ মামলায় সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় তদন্ত আইনানুযায়ী হয়নি। কেননা বিচার শুরু হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় তদন্ত করার সুযোগ নেই। মুফতি হান্নাকে দিয়ে যদি বাবর সাহেব এ ঘটনা ঘটাতেন তাহলে মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার বা দশবার রিমান্ডে নেওয়া হতো না। এটাই প্রমাণ করে এ ঘটনায় মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি জোর করে আদায় করা হয়েছে। কেননা এ স্বীকারোক্তি যখন আদায় করা হয় তখন মুফতি হান্নান অন্য মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি থাকেন কনডেম সেলে। সেখান থেকে কীভাবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেন তা স্পষ্ট নয়। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির কাছ থেকে জবানবন্দি আদায় করতে হলে যেভাবে দরকার এখানে সে বিধান মানা হয়নি। তাই বলা যায় রাজনৈতিকভাবে জড়ানোর জন্যই মূলত লুৎফুজ্জামান বাবর সাহেবকে জড়ানো হয়েছে।’
গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার ৫১ আসামির মধ্যে জামিনে রয়েছেন আটজন। তাঁরা হচ্ছেন—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন, এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমান।
আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ২৫ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তখনকার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম।
কারাগারে থাকা অন্য আসামিরা সবাই জঙ্গি সংগঠন হুজির সদস্য বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা হলেন—শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমায়রা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সি ওরফে আবুল কালাম ওরফে আবদুল মান্নান, মহিব্বুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মাইন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া এবং আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার।
নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী মারা যান।
এ ছাড়া আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, নাসিমা ফেরদৌস, রুমা ইসলামসহ শতাধিক নেতাকর্মী।
এই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুর রশিদ হয়ে মুন্সি আতিকুর রহমানের কাছে যায়।
অভিযোগ ওঠে, মুন্সি আতিক ও আবদুর রশিদ মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য জজ মিয়া নাটক সাজান। তাঁর কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করা হয়। পরিবারকে প্রতি মাসে টাকা দেওয়ার কথাও বলা হয়। মাঝে এফবিআই ও ইন্টারপোল মামলার তদন্ত করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন এ মামলার প্রথম অভিযোগপত্র দেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুফতি হান্নান ছিলেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। তাঁদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা। এ ছাড়া ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভূমিকা ছিল বলেও বলা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ৩ আগস্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য দায়িত্ব পান পুলিশের বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১০ সালের ৩ জুলাই তিনি আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
ওই অভিযোগপত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। মোট ৫২ আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান অপর মামলায় তাঁর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৫১ জন।
গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আটজন আসামি। তাঁরা হলেন—হুজি নেতা প্রয়াত মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।