৩৩ বছর সেবার প্রতিদান পেলেন নৌকার দুই মাঝি
গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে। কেবল ঘুম নেই তাঁদের চোখে ! ওপারে কে যেন এসে ডাকছে, ও দাদা পার করে নিয়ে যাও। নদীর এপার আর ওপার করতে করতে কেটে গেছে দীর্ঘ ৩৩ বছর। দুই সহোদর বিমল পাটনি (৬০) ও সাধন পাটনি (৫০)। পেশায় তাঁরা খেয়াঘাট মাঝি। পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার নৌবাড়িয়ায় গুমানী নদীর ঘাটমাঝি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
বিমল ও সাধন পাশের চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের নিমাইচড়া গ্রামের রামপ্রসাদ পাটনির ছেলে। নৌকায় মানুষকে পারাপার করে দিয়ে যা আয় হতো তাই দিয়েই চলত তাঁদের সংসার। পূর্ব পুরুষদের এ পেশা সযত্নে এত দিন আঁকড়ে ধরে ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নৌবাড়িয়া ঘাটে সম্প্রতি নৌবাড়িয়া সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এখন আর সেখানে নৌকায় পারাপারের প্রয়োজন নেই। সেতু দিয়েই চলছে মানুষ ও যানবাহন। আর এতেই যেন কপাল পুড়ে বিমল ও সাধনের!
মাঝি বিমল পাটনি ও সাধন পাটনিকে দুটি নতুন অটোভ্যান, লুঙ্গি, গামছা ও তাঁদের স্ত্রীদের একটি করে শাড়ি কাপড় দেন অতিথিরা। ছবি : এনটিভি
রোববার বিকেলে নৌকার মাঝি দুই ভাইয়ের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নৌবাড়িয়া গ্রামের যুবসমাজ। নবনির্মিত নৌবাড়িয়া সেতু চত্বরে দুই সহোদর ঘাটমাঝিকে জানানো হয় আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা। গ্রামের শত শত মানুষ অংশগ্রহণ করে ঘাটমাঝিদের এ বিদায় অনুষ্ঠানে। সেই সঙ্গে তাদের দুজন দুটি অটোভ্যান দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়। একসময়ের বিপদের বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই যেন গ্রামবাসীর এই উদ্যোগ।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সমাজসেবক আহম্মেদ মাজহারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দুই ভাইয়ের হাতে অটোভ্যানের চাবি তুলে দেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল হিরোক। এ ছাড়া গ্রামবাসীর সহায়তায় দুজনকে লুঙ্গি, গামছা ও তাদের স্ত্রীদের একটি করে শাড়ি কাপড় উপহার দেওয়া হয়।
আখিরুজ্জামান মাসুমের সঞ্চালনায় বিদায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আজেদ আলী, ফিরোজ আহম্মেদ, প্রেসক্লাব সভাপতি মাহবুব-উল-আলম প্রমুখ। বক্তারা, দুঃসময়ের বন্ধু বিমল ও সাধনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নতুন কর্মজীবনে ভালো থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে তাঁদের আজীবন নৌবাড়িয়া গ্রামের সমাজভুক্ত বলেও ঘোষণা দেন।
ঘাটমাঝি সাধন বলেন, ‘নৌকা চালানো আমাদের পিতৃ পেশা। এত দিন অতি সযত্নে ধরে রেখেছিলাম। এভাবেই কখন যে কেটে গেছে জীবনের ৩৩টি বছর তা বুঝতেই পারিনি। এখন নতুন অটোভ্যান পেয়ে বেশ ভালোই লাগছে।’
পারাপারের জন্য গুমানী নদীর ওই ঘাটে আর কোনো দিন নৌকার প্রয়োজন না হলেও বৃহত্তর এলাকার মানুষ চিরদিন মনে রাখবে তাদের বিপদের বন্ধু বিমল আর সাধনকে।
বিমল পাটনি ও সাধন পাটনি সাংবাদিকদের কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, তাঁদের বাপ-দাদার শত বছরের পেশা থেকে তাঁরা বিদায় নিলেন। তবে মানুষের ভালোবাসা ও জীবিকার জন্য নতুন অটোভ্যান পেয়ে বেশ ভালোই লাগছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভাঙ্গুড়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল হিরোক বলেন, ‘আসল মানুষকে সম্মানিত করা হয়েছে। তাঁদের বাপ-দাদা ৭০ বছরের বেশি সময় এই স্থানে খেয়া পারাপার করে মানুষের সেবা করেছেন। তাঁরা এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই দুজনকে জীবিকা নির্বাহের জন্য দুটি অটোভ্যান দিয়েছি।’