‘মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন নিয়ে গাড়ি চালাব না’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে যান চলাচল বন্ধ রেখেছে বাস মালিক ও শ্রমিক সমিতি। এর ফলে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আর এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
শ্রমিকরা বলছেন, নতুন পরিবহন আইনের খসড়া অনুযায়ী, নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং হত্যা না হলে যাবজ্জীবন শাস্তির যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেই আইন মাথায় নিয়ে তাঁরা গাড়ি চালাবেন না।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীতে কোনো বাস চলাচল করছে না। পাশাপাশি দূরপাল্লার সব বাস রাজধানীতে প্রবেশ ও ছেড়ে যাওয়া বন্ধ রয়েছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে একজন বাসচালক (৪০) এনটিভি বলেন, ‘রাস্তায় মনে করেন দুর্ঘটনা ঘটছে। ছাত্র মরছে, অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। রাস্তায় গাড়ি চললে দুর্ঘটনা হয়ই। এটা গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। আরেকটা কথা হইল, আন্দোলন কইরা তারারডা তারা সংশোধন করছে। আমাদের যে যাবজ্জীবন, জেল, কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড—এই আইন নিয়া আমরা গাড়ি চালাতে পারব না। এইজন্য আমরা গাড়ি বন্ধ রাখছি।’
সেখানে থাকা আরেকজন চালক (৪২) বলেন, ‘আমরা গাড়ি চালাই না কারণ, ড্রাইভারের মৃত্যুদণ্ড বা হেলপারের যাবজ্জীবন, এসব নিয়া আমরা গাড়ি চালাব না।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই চালক জানান, তিনি চার দিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন না।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ছাড়া আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। নিহত শিক্ষার্থীরা হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব।
এ ঘটনায় নিহত দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৩৩। এটি একটি হত্যা মামলা।
এরপর গত বুধবার পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নতুন আইন করা হচ্ছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। নতুন এ আইনে চালকদের লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন গাড়িসহ নানা নিয়মনীতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
আইনমন্ত্রী জানান, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় যে শাস্তি হওয়া উচিত, তার সর্বোচ্চটাই থাকছে এই সড়ক পরিবহন আইনে। আইনটিতে দ্রুতগতিতে বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ।
এ ছাড়া কোনো অপরাধী আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থাও এ আইনে থাকছে। কেউ বড় অপরাধ করে কম শাস্তি পাবে না। আবার ছোট অপরাধ করে বড় শাস্তি পাবে না। এ ছাড়া চালকের ভুলের শাস্তি হিসেবে আইনটিতে ১২টি বিধান রাখা হয়েছে বলেও আইনমন্ত্রী জানান।
এদিকে খসড়া যে আইনটি প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ‘দুর্ঘটনার সাজা দণ্ডবিধিতে’ বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে দণ্ডবিধি অনুযায়ী। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। হত্যা না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে।
বাস না ছাড়ার ব্যাপারে গাবতলী বাস টার্মিনালের একটি বাস কোম্পানির সেলসম্যান নজরুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘গাড়ি ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারে মালিক সমিতির কোনো নির্দেশনা নেই। আমি বসে আছি গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায়। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। রাস্তাঘাট পয়-পরিষ্কার থাকবে, আমরা গাড়ি ছাড়ব। সবাই বন্ধ রাখছে, আমরাও বন্ধ রাখছি। সবাই গাড়ি ছাড়বে আমরাও ছাড়ব।’
তবে এ ব্যাপারে নোয়াখালী রুটে চলা সেবা ট্রান্সপোর্টের সুপারভাইজার আবদুল হালিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের অফিসের (মালিকের) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখার জন্য। এ কারণে সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে।’ তিনি বলেন, সায়েদাবাদ থেকে দূরপাল্লার সব বাস বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামের ড্রিমলাইন, হিমাচল, এনা পরিবহন , হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, স্টার লাইনসহ সব বাস সকালবেলা থেকে চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ছাত্ররা মালিকদের ফাঁসি চায়, শ্রমিকদেরও ফাঁসি চায়। এ কারণে সকাল থেকে শ্রমিকরা সকাল থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আমরা মালিক সমিতি চাই গাড়ি চলুক। কিন্তু শ্রমিকরা না চালালে আমরা কী করব?’
মেহেদি হাসান নামের এক যাত্রী জানান, সকাল থেকে কোনো বাস না চলায় গ্রামের বাড়িতে যেতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘অসুস্থ পরিবারের পাশে থাকার জন্য গ্রামের বাড়ি যেতে রওনা হয়ে সকাল থেকে তিন ঘণ্টা বাস কাউন্টারে বসে আছি। কিন্তু কোনো বাস যাচ্ছে না।’
একইভাবে শুধু রিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল না করায় রাজধানীবাসী নিজস্ব গন্তব্যে যেতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় সকাল থেকে কোনো যান চলাচল করতে দিচ্ছে না শ্রমিকরা। লাঠিসোটা নিয়ে সব গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।