বাউলশিল্পী বিউটিকে মানিকগঞ্জে দাফন
প্রখ্যাত বাউলশিল্পী বিউটি সরকারের (৩৮) লাশ মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার উত্তর তরা গ্রামে দাফন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
এর আগে গতকাল বুধবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জয়দেবপুর থানার তিতারকুল বিল থেকে বিউটির লাশ উদ্ধার করে। মঙ্গলবার রাতে ট্রলারে করে বেড়াতে নিয়ে তাঁরই স্বামী সেলিম মিয়া (২৮) ও সহযোগীরা মারধর করে বিলের পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে বলে পুলিশ ও স্বজনরা জানিয়েছে। এ ঘটনার পর পরই বিউটির স্বামীসহ পাঁচজনকে ধরে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা।
আটক ব্যক্তিরা হলেন বিউটির স্বামী গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জোলারপাড় এলাকার সেলিম মিয়া (২৮) ও তাঁর সহযোগী গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পশ্চিম জয়দেবপুর এলাকার মামুন সিদ্দিকী (২৮), লক্ষ্মীপুরা এলাকার রুবেল (২৮), পূর্ব ভুরুলিয়া এলাকার শাকিল (১৪) ও নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী এলাকার লিটন মিয়া (৩০)।
বিউটির সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্পর্কে সেজো বোন জরিনা আক্তার জানান, সাত বোনের মধ্যে বিউটি বড়। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। বাড়িতে হারমোনিয়াম ও তবলা বাজিয়ে গান করতেন বিউটি। উত্তর তরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পর পাশের মূলজান উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপাড়া করেন বিউটি। ১৯৯২ সালে মানিকগঞ্জ শহরের বান্দুটিয়া এলাকার লালমিয়া নামের একজন প্রবাসীর সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাঁর। এ কারণে তিনি আর লেখাপড়া করতে পারেননি। লালমিয়া ও বিউটির সংসারে সোহাগ মিয়া ও সূচনা আক্তার নামের দুই সন্তানের জন্ম হয়। এরপর নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় ২০০৯ সালে লালমিয়ার সঙ্গে বিউটির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। সোহাগ বর্তমানে ওমান থাকেন। আর সূচনার বছর খানেক আগে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া এলাকায় বিয়ে হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর বিউটি শিবালয় উপজেলার সাহেলী গ্রামের জালাল সরকারের কাছে থেকে বাউল গান শিখেন। অল্প দিনেই তিনি দর্শক ও শ্রোতাদের মন জয় করে নেন। বিউটি বিশ্বাস থেকে তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন বিউটি সরকার নামে। বাউল গানের অন্তত ১৫টির মতো অডিও ও ভিসিডি বের হয় এই শিল্পীর। দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বাউল গান গাইতেন বিউটি। গাজীপুরে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয় কাপড়ের দোকান কর্মচারী সেলিমের সঙ্গে। সেলিম বয়সে তাঁর থেকে ছোট হলেও দেড় বছর আগে দুজনের মধ্যে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে গাজীপুর শহরে বাসা নিয়ে থাকতেন তাঁরা। সেখান থেকেই বিভিন্ন স্থানে গিয়ে গান গাইতেন বিউটি। গাজীপুর থেকেও তাঁর বেশ কয়েকটি ভিসিডি অ্যালবাম বের হয়। এরমধ্যে ‘আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গড়া’ অ্যালবামটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
বিউটির বাবা আবদুল মজিদ বিশ্বাস জানান, বিয়ের পর থেকে বিউটিকে বাউল গান গাওয়া ছেড়ে দিতে বলেন সেলিম। তা না শুনে বিউটি বিভিন্ন স্থানে বাউল গান গাইতে যেতেন। এ কারণে সেলিমের সঙ্গে তাঁর কলহের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় গত মঙ্গলবার বিকেলে বিউটিকে নিয়ে সেলিম ও তাঁর সহযোগীরা তিতারকুল বাজার থেকে একটি ট্রলারে (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) পূবাইল এলাকায় বেড়াতে যান। রাত ১১টার দিকে ফেরার পথে তিতারকুল বাজারের অদূরে এসে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে বিউটিকে মারধর করেন সেলিম। সহযোগীরাও মারধরের সময় সহযোগিতা করেন সেলিমকে। মারধরের একপর্যায়ে বিউটিকে ট্রলার থেকে বিলের পানিতে ফেলে দেন তাঁরা। এ সময় ট্রলারের মাঝি শাহ আলম বিষয়টি মোবাইল ফোনে স্থানীয়দের জানান। স্থানীয়রা গিয়ে ওই পাঁচজনকে ধরে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ তাঁদের আটক করে এবং রাতেই বিউটিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। পরের দিন দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বিউটির লাশ উদ্ধার করে। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে বিউটির লাশ নিয়ে আসা হয়। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ওমান থেকে ছেলে সোহাগ আসার পর তাঁর লাশ দাফন করা হয় বলেও জানান বিউটির বাবা মজিদ।
জয়দেবপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আহাদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ওই বিল থেকে বিউটির লাশ উদ্ধার করে। এরপর গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় বিউটির বাবা থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। ওই পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ হত্যা মামলাটির তদন্ত কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।