টাকার বিনিময়ে কাসিদা দলের সাহরির আহ্বান!
তখন রাত ২টা ২০ মিনিট। হঠাৎ একদল তরুণের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ঐতিহ্যবাহী কাসিদা, ‘সাহরি খাও, রোজা রাখ। পিয়ারে মুসলিম ওঠ রে, সময় যে গেলো রে। নামাজ পড়, রোজা রাখ, আল্লার পথে চল রে।’ এরপর অলিতে-গলিতে একে একে কয়েকটি কাসিদার দলকে বের হতে দেখা যায়। তারা রোজাদারদের সাহরি খাওয়ার আহ্বান জানাতে জানাতে উচ্চস্বরে কাসিদা গেয়ে চলে।
রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ার নিয়মিত দৃশ্য এটি। প্রতি রাতেই সেখানে কয়েকদল তরুণ দলবেঁধে এভাবে কাসিদা গেয়ে সাহরির আহ্বান জানান। রাত ২টা ২০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে এভাবে চলতে থাকে ৩টা পর্যন্ত। কাসিদার দলের সেহরির আহ্বান জানানো শেষে হলে শুরু হয় মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি, গজল কিংবা কোরআন পাঠ।
পূর্ব কাজীপাড়ার মোট ১০টি গলিতে কমপক্ষে সাতটি দলে বিভক্ত হয়ে এসব কাসিদার দল ঘুরে বেড়ায়। এদের প্রত্যেকটি দলে চার থেকে সাতজন পর্যন্ত দেখা যায়। ওই এলাকা ঘুরে এমন পাঁচটি দলের দেখা মেলে গত তিন রাতে। এরা সবাই পূর্ব কাজীপাড়ার স্থানীয়। অধিকাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে।
কাসিদার উচ্চস্বরে অনেকেই ঘুম থেকে জেগে উঠেন। অনেকেই আবার বিরক্ত হন। এই বিরক্তির তালিকাতে সব ধর্মের লোকজনই আছেন। কেউ বলেন, ‘আমি তো রাতভরই জেগে থাকি তাহলে এটা কী দরকার?’ কেউ বলেন, ‘ফোনেই অ্যালার্ম দেই, আমার এটার দরকার নেই।’ কেউ আবার এটার প্রয়োজনীতাও দেখেন। কেউ কেউ আবার এটাকে শুধু চাঁদা তোলার ফন্দি হিসেবে দেখেন।
এভাবে কাসিদার মাধ্যমে পূর্ব কাজীপাড়ায় সেহরি খাওয়ার আহ্বান জানানো অনেক পুরোনো বলে স্থানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তারা জানায়, অনেক আগে থেকে এই প্রথা চলে আসছে। তবে আগেকার সময়ের মতো এখন আর নেই। প্রতি ফ্ল্যাট থেকে ১০০ থেকে শুরু করে ৫০০টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে পূর্ব কাজীপাড়া বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যারা ভোরে রোজাদারদের ডাকে তারা রোজার শেষে হয়তো কিছু টাকা পয়সা নেয় ফ্ল্যাট থেকে। তবে জোর করে আদায় করে বলে আমার জানা নেই। যে যা পারে তাদের কাছ থেকে তেমন নেয়।’
আলমগীর বলেন, ‘২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী পাঁচশোর উপর বাড়ি আছে এখানে। তবে কী পরিমাণ চাঁদা উঠে তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না।’
পূর্ব কাজীপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে এনটিভি অনলাইনের কথা হয়। তারা জানায়, প্রতি ফ্ল্যাট থেকে কমপক্ষে ১০০ টাকা করে নেয় এরা। যারা মোটেই দিতে চায় না তাদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নেয়। এরপর কত টাকা নেবে তার কোনো হিসাব নেই। যার কাছ থেকে যেমন নিতে পারে। কারো কাছ থেকে ২০০, কারো কাছ থেকে ৫০০।
এদের ভেতরে পূর্ব কাজীপাড়ার স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তো কখনোই ৪০০-৫০০ টাকার নিচে নেয়নি। সবাই এলাকার ছোট ছোট পোলাপান। কমবেশি চেনে আমাকে। কম করে ধরেন, পূর্ব কাজীপাড়ায় যদি ৫০০ বাড়ি থাকে। তাহলে গড় পড়তায় প্রতি বাড়িতে কমপক্ষে ১০টি ইউনিট আছে। সুতরাং মোট পাঁচ হাজার ইউনিট আছে। এখন যদি প্রতি ইউনিট গড়ে ১৫০ টাকা করেও ধরেন তবে সাড়ে সাত লাখ টাকা চাঁদা উঠার কথা।
ওই এলাকার মোট পাঁচটি কাসিদা গায়ক দলের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। কথার এক পর্যায়ে যখন চাঁদা উঠানো বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন তারা আর কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। এমনকি তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক গলিতে গলিতে ঘুরে কাসিদার তালে তালে গাইলেও পরে তারা ছবি না তোলার জন্য অনুরোধ করে এবং আর কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। সঙ্গে তারা কেউ নামও প্রকাশ করতে চায়নি।
তাদের ভেতরে কয়েকজন জানায়, একেক জনের চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। তবে প্রতিদিন ডাকা এটা তো কষ্টও বটে।
আপনারা যে টাকা তুলেন সেই টাকার ভাগ নেন কতজন-এমন প্রশ্নে তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বোঝেনই তো। আপনাকে কেউ যদি শেলটার দেয় সে সুযোগ নিবে না? সেই রকম, টাকা তোলার সময় ভাই-বেরাদররা যায় সাথে।’
কাসিদা কী?
কাসিদা আরবি শব্দ। এর অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ইসলাম ধর্মের প্রথম পর্বেই আরবি সাহিত্যে কাসিদার বড় ভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষায়ও প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে ফারসি, তুর্কি, উর্দু ভাষায় কাসিদার বিস্তর দেখা মেলে। পুরান ঢাকায় পবিত্র রমজান এলেই সাহরির সময় মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়া হতো। উদ্দেশ্য, রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানো। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ বইতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে, নবাবি আমলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লার সর্দাররা কাসিদা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর সময় কাসিদা গাওয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। নবাব নিজে কাসিদা রচনা করতেন। আহসান উল্লাহর রচিত উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘কুল্লিয়াতে শাহীন’-এ বেশ কিছু কাসিদা স্থান পেয়েছে।
এ ছাড়া বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথনের মোগল অভিযানের বর্ণনামূলক গ্রন্থ বাহারিস্থান-ই-গায়েবিতেও মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় কাসিদা চর্চার উল্লেখ রয়েছে। কাসিদা গাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ, উচ্চারণ, সুর, তাল, লয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাসিদা গায়করা পাক-পবিত্রতা, আদবের সঙ্গে গান পরিবেশন করে থাকে। কাসিদা সংস্কৃতি যখন খুবই পরিচিত ছিল, তখন প্রযুক্তিগত দিক এখনকার প্রযুক্তির মতো উন্নত ছিল না। টিন কেটে মাইকের মতো চোঙা বানিয়ে তা দিয়ে ঘুমন্ত মানুষদের জাগানো হতো। কিন্তু এখন আর সেই প্রচলন নেই। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কাসিদা সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে।
কাসিদা আগে যেমন ছিল
যখন থেকে কাসিদার যাত্রা শুরু হয় তখন ধর্মীয়মনারা এই কাসিদা গাইত। ঘুম ভাঙাত এলাকাবাসীর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহান আল্লাহুর সন্তুষ্টি অর্জন। সেহরির বেশ আগে থেকে কাসিদার গায়করা পাক-পবিত্র হয়ে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরিধান করে পাড়া বা মহল্লায় বের হতো। গায়করা একটি টিন বক্স জাতীয় বক্স রাখতেন যাতে ওটা ব্যবহার করে কাসিদার সঙ্গে শব্দ সৃষ্টি করে রোজাদারদের ডাকা যায় এবং এটার বিনিময়ে তারা কোনো ধরনের অর্থ বা উপহার চাইতেন না। তবে কেউ নিতান্তই খুশি হয়ে দিলে নিত তারা।
বর্তমানে যেমন
সাধারণত সব এলাকাতে কাসিদা গায়কের দেখা মেলে না। তবে এখনো কোথাও কোথাও কাসিদার প্রচলন রয়েছে। রাজধানীর কাজীপাড়া, মিরপুর ১২, সোবহানবাগ, শুক্রাবাদ এবং কল্যাণপুরসহ কয়েকটি এলাকাতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত ওই এলাকার স্থানীয়রা কাসিদা গেয়ে থাকে।