‘প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়া’ সেই সাব-রেজিস্ট্রারকে বরখাস্ত
ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও আড়াইহাজার উপজেলার দায়িত্বরত সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান আজ রোববার এক অফিস আদেশে এই নোটিশ দেন।
এছহাক আলী মণ্ডলের বিরুদ্ধে কয়েক দিন ধরে আড়াইহাজার উপজেলার দলিল লেখকদের কলম বিরতি ও এলাকাবাসীর মানববন্ধন চলছিল। টাকা নেওয়ার ভিডিও ফুটেজ কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। আর সে কারণে তড়িঘড়ি করে এছহাকের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ভুক্তভোগীরা তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছে।
ভুক্তভোগী ও দলিল লেখকরা বলেছেন, জমির দলিল রেজিস্ট্রি করতে সিনেমার কায়দায় টেবিলের ড্রয়ার খুলে রাখেন এছহাক আলী মণ্ডল। কোনো গ্রাহক বা দলিল লেখক ড্রয়ারে টাকার পরিমাণ কম রাখলে তাও তিনি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দেন। এছহাক আলী মণ্ডল ঘুষ ছাড়া তো কাজ করেনই না, তাও আবার যেন তেন নয়, কয়েক গুণ বেশি ঘুষ দিতে হয় তাঁকে। নয়তো কাজ হয় না। এ ছাড়া তিনি দলিল লেখকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে একাধিক দলিল লেখক অভিযোগ করেছেন।
এছহাককে পাঠানো সাময়িক বরখাস্তের আদেশে যা আছে
নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু আপনি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার (খণ্ডকালীন সাব-রেজিস্ট্রার, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ) জনাব এছহাক আলী মণ্ডল বিগত ২২-৩-২০১৮ খ্রি. তারিখ বৃহস্পতিবার আড়াইহাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ গ্রহণ করিয়া দলিল রেজিস্ট্রি করিবার ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হইয়াছে এবং ভিডিওটিতে দেখা যায়, আপনি আড়াইহাজার অফিসে খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন কালে টেবিলের উপরে ফাইলের স্তূপ, প্রতিটি ফাইলে স্বাক্ষর করিবার আগে ঘুষ নিচ্ছেন এবং পাশ থেকে একজন ফাইল এগিয়ে দিচ্ছেন আর প্রতিটি ফাইলের সঙ্গে টাকা নিয়ে ড্রয়ারে রাখছেন এবং ফাইল স্বাক্ষর করার পর সেই টাকা আপনার প্যান্টের পকেটে ডুকাচ্ছেন।
যেহেতু ভিডিওটিতে আপনি ঘুষ নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করিবার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি।
সেহেতু, আপনি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর সাব-রেজিস্ট্র অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার জনাব এছহাক আলী মণ্ডল সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধি, ১৯৮৫-এর বিধি ৩ (বি) ও (ডি) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতিপরায়ণমূলক অভিযোগে অভিযুক্ত।
এমতাবস্তায়, আপনি জনাব এছহাক আলী মণ্ডল, সাব-রেজিস্ট্রার, বন্দর, নারায়ণগঞ্জকে উপরোল্লেখিত অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের দায়ে প্রশাসনিক ও জনস্বার্থে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হইল। একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধি, ১৯৮৫-এর বিধি ৩ (বি) ও (ডি) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে বিভাগীয় মামলা রুজু করত কেন আপনাকে সরকারি চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হইবে না বা অন্য শাস্তি প্রদান করা হইবে না তদমর্মে অত্র পত্র প্রাপ্তি ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে নিম্নস্বাক্ষরকারী বরাবরে কারণ দর্শানোর নির্দেশ প্রদান করা হইল।’
আদেশের নিচে সই করেছেন নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান।
এ দিকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে সাব-রেজিস্ট্রার ইছহাক আলী মণ্ডল বলেছেন, সরকারি রাজস্ব আদায় করেন তিনি। তিনি সততার সঙ্গে কাজ করেন বলে কয়েকজন নবীন মোক্তার তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলকে প্রত্যাহারের দাবিতে দলিল লেখকরা আজ রোববার কর্মবিরতি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ছবি : এনটিভি
ইছহাক আলী মণ্ডল বলেন, ‘সরকারি রেভিনিউ আদায় করতেছিলাম এবং আমার এইটা কাজ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ এবং আমি যেহেতু ওখানকার কর্মকর্তা সরকারি যেটা ফি সেগুলো আমাকে নিজেই আদায় করতে হয়। কেননা আমি পার্টটাইমের অফিসার ওখানে। সরকারি ফি-টা আমি নিজে আদায় করতেছি। এটা কোনো ঘুষের টাকা না, বাহিরের কোনো টাকা না। আমি তো প্রকাশ্যে আদায় করতেছি। এটা রেভিনিউ, আমার দায়িত্ব, পবিত্র দায়িত্ব। এটাই আমার কাজ, সরকারি রেভিনিউ আদায় করা।
আদায়গুলা কতগুলো কোর্ট ফির মাধ্যমে আদায় করা হয়, পে অর্ডারের মাধ্যমে, কতগুলা আছে ক্যাশ টাকা আদায় করতে হয়, এটা পরের দিন সোনালী ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়।’
এমনকি ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান কঠোর বলেও জানান এই সাব-রেজিস্ট্রার। তিনি কাউকে কোনোদিন কোনো অসৎ কাজ করার সুযোগ দেননি দাবি করে এই কর্মকর্তা জানান, সে কারণেই একটি মহল তাঁকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছে। আর তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা সাব-রেজিস্ট্রার সাবিকুন্নাহার জানান, ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি তিনি সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওসহ দেখেছেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার সাব-রেজিস্ট্রার ইছহাক আলী মণ্ডল আড়াইহাজার কার্যালয়ে কাজ করতেন।
সাবিকুন্নাহার বলেন, কিছু দলিল রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে এখনো নগদ অর্থ নেওয়া হয়। ওইদিন ওই অফিসে আসলে কী ঘটেছে সেটি তদন্ত করার পর বলা যাবে।