৭ মার্চের ভাষণ একটি মহাকাব্য : জাফর ইকবাল

জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ একটি কাব্য, একটি মহাকাব্য।
আজ শনিবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত নাগরিক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর কাছে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে’র স্বীকৃতি পাওয়া উপলক্ষে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপবি) শিক্ষক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার সামনে ৫০ থেকে বেশি হলেও ১০০ জন ছাত্র থাকে। কিন্তু আমি আজ যখন কথা বলছি। আমার সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এটি অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। সেটি আমি জানি। আজ আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭১ সালে এটার নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। এই রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে আমি একধরনের শিহরণ অনুভব করছি।’
লেখক বলেন, ‘আমি সেই উদ্যানে দাঁড়িয়েছি, যেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে খুব কম দেশ আছে, যে দাবি করতে পারবে যে, একটি দেশ ও একটি মানুষ সমার্থক। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা তা দাবি করতে পারি। কারণ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। যদি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হতো আমরা এই বাংলাদেশ পেতাম না। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে, এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। তিনি সমস্ত বাঙালিকে একত্র করেছিলেন। তিনি আমাদের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। যেই স্বপ্ন দেখে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে আমাদের এই দেশ উপহার দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বসে আছেন। তাঁদেরকে আমি সালাম জানাই যে তাঁরা আমাদের এই সুন্দর দেশ উপহার দিয়েছেন। আমি শিক্ষক মানুষ, আমি আমার ছাত্রদের বলি তোমরা দেশকে ভালোবাসো। দেশকে ভালোবাসার সোজা রাস্তা কী? সোজা রাস্তা হলো দেশের ইতিহাসকে জানো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি জানো, তাহলে তুমি অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যদি জানতে হয়, আমাদের সবাইকে ৭ই মার্চের ভাষণকে জানতে হবে।’
কল্পবিজ্ঞান লেখক বলেন, ‘আমরা নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু নতুন প্রজন্ম দেখে নাই। শুধুমাত্র তথ্য জানলে হবে না। তোমাদেরকে ৭ই মার্চকে অনুভব করতে হবে। তা না হলে তোমরা বংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক হতে পারবে না। ৭ই মার্চের ঘটনা, ৭ই মার্চের ভাষণ জানার জন্য আমাদের সেই সময়টাকে বুঝতে হবে। তখন ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রায় সবগুলো সিট (আসন) পেয়েছিলেন। তিনিই হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো তারা ঠিক করেছে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না। লারকানায় বসে তারা পাখি শিকারের নামে তারা ষড়যন্ত্র করে সমস্ত নীলনকশা তৈরি করে রেখেছে। পহেলা মার্চ তারা ঘোষণা করে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে না। সমস্ত বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে পড়ল একটা বিক্ষোভের শহর, একটা মিছিল, একটা বিক্ষোভের মিছিল।’
জাফর ইকবাল আরো বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে। তখন কী পরিবেশ ছিল? সমস্ত প্লেনে করে মিলিটারি আর মিলিশিয়া আনা হচ্ছে। এখানে আঘাত করার জন্য। এবং সেই সময় সমস্ত দেশ বিক্ষুব্ধ। বঙ্গবন্ধুর কথায় দেশ চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা তোলা হয়েছে। আমাদের যে প্রিয় জাতীয় সংগীত, সেই সংগীতের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা অপেক্ষা করছে একটা কোনো ভুল হলে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধু এখানে দাঁড়িয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন। আকাশে হেলিকপ্টার ঘুরছে, চারদিকে মিলিটারিরা অপেক্ষা করছে। একটা যদি সুযোগ পায়, তারা রক্তের বন্যা বইয়ে দেবে। বঙ্গবন্ধু তখন সেই ভাষণ দিলেন। যে এই ভাষণটি শোনেনি, অনুভব করেনি, সে বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক হতে পারবে না। আমাদের পাঠ্যবইয়ে এই ভাষণটি দেওয়া আছে, ছেলেমেয়েরা এই ভাষণটি পড়ে। শুধু পড়লে হবে না তাদের কানে শুনতে হবে। তাহলে তারা অনুভব করতে পারবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ভাষণ খুব বেশি নাই। পৃথিবীর বড় বড় ভাষণ আছে আমি দেখেছি। সেখানে তাঁরা কাগজে লিখে নিয়ে এসে পড়েন।’
ঔপন্যাসিক বলেন, “ভালো ভাষণ কিন্তু কাগজে লিখে নিয়ে এসে পড়েন। আমাদের বঙ্গবন্ধু, ১৯ মিনিটের সেই ভাসণে তাঁর কাছে কোনো কাগজ ছিল না। তিনি তাঁর চশমা খুলে সামনে রেখে দিয়েছিলেন। এটি শুধু ভাষণ নয়, এটি কাব্য, এটি মহাকাব্য। এটি আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ইতিহাস। ফিদেল কাস্ত্রো যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ফিদেল কাস্ত্রো পৃথিবীর অনেক বড় একজন নেতা। তাঁকে অনেকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু তাঁকে হত্যা করতে পারে নাই। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। তাঁকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি নাই। এই দুঃখ আমরা কোথাই রাখব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটাকে আমরা যদি সফল করতে পারি, শুধুমাত্র তাহলেই মনে হবে যে হ্যাঁ তাঁর স্বপ্ন সফল করার জন্য তিনি যে প্রাণ দিয়েছিলেন তার একটুখানি হলেও শোধ হবে। কাজেই আমাদের হাতে সেই দায়িত্ব।”
জাফর ইকবাল বলেন, “বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদেরকে সে স্বপ্ন গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ সেই শত্রু নাই কিন্তু এখন নতুন শত্রু জন্ম নিয়েছে। আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। যিনি লেখক তাঁর কলম আছে তিনি কলম দিয়ে মোকাবিলা করবেন। যিনি গায়ক তিনি তাঁর কণ্ঠ দিয়ে মোকাবিলা করবেন। যিনি শিল্পী তিনি তাঁর ছবি দিয়ে মোকাবিলা করবেন। আমাদের এই বাংলাদেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। অনেক সময় আমরা যাঁকে পুরস্কার দিই, তাঁকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করি। অনেক সময় উল্টোটা হয়। যিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করেন। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণটাকে গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেছে। বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। কিন্তু আমি বলব, ইউনেসকো সম্মানিত হয়েছে। তারা বলতে পারবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি এখন আমাদের কাছে আছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার সামনে ৫০ থেকে ১০০ জন থাকে। আমার স্লোগান দিতে ভালো লাগে কিন্তু আমি সুযোগ পাই না। আজ আমি সুযোগ পেয়েছি। আজ আমি একটি স্লোগান দেই আপনারা আমার সাথে যোগ দিন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। সবাইকে ধন্যবাদ।”