ডুমুরিয়ায় বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি, ভাসছে ঘের-ঘর

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর শরাফপুর ইউনিয়নের চাঁদগড়ে ৩০০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত ১১টা পর্যন্ত স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধটি আটকাতে সক্ষম হলেও রাত ১২টার দিকে জোয়ারের তোড়ে সেটি আবারও ভেঙে যায়।
আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জোয়ারের পানি হু হু করে বিলে প্রবেশ করছে। দ্রুত বাঁধটি আটকাতে না পারলে সংলগ্ন তিনটি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম জলাবদ্ধতার শিকার হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় লোকজন জানান, গতকাল দুপুর থেকে আজ পর্যন্ত ভাঙনের ফলে এই এলাকার কয়েকটি বিলের কয়েক শ মাছের ঘের ভেসে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহকারী প্রকৌশলী কৃষ্ণপদ জানান, ভদ্রা নদীর প্রবল স্রোতের কারণে কয়েক বছর ধরে জালিয়াখালী এলাকার বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এরই মধ্যে মূল বেড়িবাঁধ নদীর মধ্যে চলে গেছে। মাস দুয়েক আগে ওই স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণে বিকল্প ওই বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া নদীতে জোয়ারের পানির স্রোত অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিক উচ্চতার বেশি উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সে কারণে বিকল্প বাঁধ পানির চাপ সহ্য করতে পারেনি। গতকাল বিকেলের জোয়ারে জালিয়াখালী-চাঁদগড় এলাকার ৫০ ফুট এলাকা ভেঙে যায়। যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং এতে ৩০০ ফুটের মতো এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে নদী সংলগ্ন চাঁদগড়, আবড়া, বাহির আকড়া বিলের কয়েকশ চিংড়ি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধ দেওয়া সম্ভব না হলে শরাফপুর, সাহস, ভাণ্ডারপাড়াসহ সংশ্লিষ্ট এলাকা জলাবদ্ধতার শিকার হবে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল রাতে মসজিদের মাইক থেকে এলাকাবাসীকে বাঁধ মেরামতের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। রাতেই বাঁধ আটকানো হয়। কিন্তু একটু পর রাত ১২টার দিকে জোয়ারের পানিতে সেই বাঁধ আবারও ভেঙে যায়। পরে সকালে ভাটা হলে বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ আটকানোর চেষ্টা করা হলেও তাও আজ দুপুরের জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে। নদীর পাশে বসবাসরত অধিবাসীরা এখন উঁচু স্থানে আশ্রয় খোঁজা শুরু করেছে। অনেকে ঘর ছেড়ে বেড়িবাঁধে পলিথিন মাথায় দিয়ে অপেক্ষায় আছে কখন বাঁধ আটকানো হবে আর জোয়ারের পানি আসা বন্ধ হবে।
চাঁদগড় গ্রামের বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম (৬২) জানান, গতকাল সকালে একবার রান্না করেছেন। এরপর আর রান্না করতে পারেননি তিনি। তাঁদের ঘরের একটি অংশ ভেঙে নদীতে চলে গেছে। শুকনা চিঁড়া খেয়ে কোনো রকমে দিন পার করেছেন। ঘরে খাওয়ার পানি নেই। অনেক দূর থেকে খাওয়ার পানি আনতে হয়। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির কারণে সেটাও করতে পারছেন না।
একই গ্রামের বৃদ্ধা সুরাইয়া বেগম (৬০) বলেন, ‘এই ওয়াপদায় উঠিছি আর কখন নিচে ঘরে নামব বলতি পারছিনে। পলিথিন মুড়ি দে থাকতি হচ্ছে। বৃষ্টির সাথে বাতাসে শীত তাই কাঁপুনি হচ্ছে।’
আবদুল হক গাইনের বৃদ্ধা স্ত্রী জরিনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গত বছর নদীভাঙনে ঘরবাড়ি, গাছগাছালি নদীতে চলে গেছে। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। বেড়িবাঁধের ভেতরে একটু জমি কিনে সেখানে ঘর বেঁধে বসবাস করছি। এখন আবার এই ঘরের ওপর দিয়ে নাকি বাঁধ দেবে।’ তিনি আরো জানান, গত সপ্তাহে ৩২ হাজার টাকার রেণু পোনা ও সাদা মাছ চাঁদগড় বিলের ঘেরে ছেড়েছিলেন। গতকাল বেড়িবাঁধ ভেঙে সব তলিয়ে গেছে। এই কষ্টে আজ সারা দিনেও কিছু মুখে দিতে পারেনি তাঁর দুই ছেলে।
চাঁদগড় গ্রামের বাসিন্দা কারিমুল গাইন (৫৪) বলেন, ‘শুকনার সময়ে যদি বাঁধটি মেরামত করা হতো তাহলে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হতো না। ঠিকাদার পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজে গড়িমসি করেছে।’
এ বিষয়ে শরাফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম জানান, চাঁদগড় এলাকায় ভাঙনের সমস্যা দীর্ঘদিনের। দু-তিন মাস আগে এই স্থানের বাঁধটি ভাঙতে শুরু করলে পাউবো বাঁধ মেরামতের জন্য ৪৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করতে গড়িমসি করায় আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ গত জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শেখ আবদুল কাদের বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ৩৬টি পরিবার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষ। দ্রুত বাঁধ আটকানো না গেলে শরাফপুর, ভাণ্ডারপাড়া ও সাহস ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের ৬০ হাজার মানুষ বিপর্যয়ের কবলে পড়বে।
ডুমুরিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মাদ সামছু দ্দৌজা বলেন, বৃষ্টিতে বাঁধের মাটি দুর্বল হয়ে পড়ায় তা ভেঙে গেছে। বাঁধ মেরামতের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে শ্রমিক দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ইউএনও আরো বলেন, ‘শনিবার ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তাঁরা পাউবো ও ঠিকাদারের গাফিলতিতে বাঁধ সংস্কারে বিলম্ব হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।’
এ বিষয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তাঁর কার্যালয় থেকে জানানো হয় তিনি ঢাকায় আছেন। তবে বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী কৃষ্ণপদ জানান, বাঁধরক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন উপকরণ পানি উন্নয়ন বোর্ড সরবরাহ করেছে। বাঁধটি পাউবোর অর্থ সংকটের কারণে সময়মতো মেরামত করা যায়নি বলেও স্বীকার করেন তিনি।