ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতশিল্প বিলুপ্তির পথে
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও চাষাবাদ কমায় এবং প্লাস্টিক পণ্যের ভিড়ে বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতশিল্প। ফলে এ পেশায় নিয়োজিত শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
দীর্ঘদিন বংশপরম্পরায় করে আসা অনেকে এ পেশা ছেড়ে নিয়োজিত হচ্ছেন ভিন্ন পেশায়। সরকারি সহায়তা পেলে ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব এ কুটির শিল্প রক্ষাসহ এর সঙ্গে জড়িতরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে অভিমত এলাকাবাসীসহ বিজ্ঞজনের।
জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি, মানিকদী, পূবেরকান্দা, বাঘাইকান্দি, চাতালচরসহ বিভিন্ন গ্রামের লোকজন বাঁশ-বেতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখানকার বাঁশ-বেতশিল্পীরা তাঁদের সুনিপুণ হাতের কারুকাজে তৈরি করতেন নানা শৌখিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় হরেক সামগ্রী। এর মধ্যে রয়েছে শীতলপাটি, চাটাই, ডুল, জাবার, হাতপাখা, ডুলা, খলই, ওড়া, পাইছা, ঝুড়ি, চালনা, কুলা, মুড়া, চাঁই। পরিবারের সবাই এ কাজ করতে পারে বলে তাদের জীবন চলত বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। দ্রুত এটি প্রসারিত হয় পাশের কুলিয়ারচর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে। এ শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী হিসেবে বাঁশের চাষও হতে থাকে বাড়ি বাড়ি।
কিন্তু ওই সব এলাকার বাঁশ-বেতশিল্পের সে ঐতিহ্য আর নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন আবাসন তৈরিতে ভূমি ব্যবহার হতে থাকায় বাঁশ চাষের প্রয়োজনীয় ভূমি একদিকে কমে গেছে। অপরদিকে বাজারে এ শিল্পসামগ্রীর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের নানা দ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং সেসব সামগ্রী তুলনামূলকভাবে দামে কম হওয়ায় ধীরে ধীরে এ কুটির শিল্পে নেমে আসে ধস। ফলে অধিক পরিশ্রম করে এ সামগ্রী তৈরি করে সংসার চালানোর মতো টাকা রোজগার করতে না পারায় এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। আর যাঁরা নিরুপায় হয়ে এ পেশায় জড়িয়ে আছেন, তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মানিকদী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আদম আলী জানান, জমিজমা না থাকায় এখনো এ পেশায় জড়িয়ে আছেন তিনি।
প্রায় একই বক্তব্য বাঘাইকান্দির সিরাজ মিয়ার। তিনি জানান, অন্য কোনো কাজ পারেন না বলেই তিনি এখনো এ পেশায় আছেন।
তবে ভিন্ন কথা বললেন চকবাজার এলাকার কুদ্দুস মিয়া। তিনি জানান, তিনি তাঁর তিন ছেলে ও ছেলের বউদের নিয়ে বাঁশ-বেতশিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে বেশ আছেন। তবে পুঁজির অভাবে অনেক সময় বাজারের চাহিদামতো সামগ্রী তাঁরা সরবরাহ করতে পারেন না।
এদিকে এলাকার সমাজকর্মী রইছ মিয়া, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য জাফর ইকবাল ও কৃষক রেনু মিয়া অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী এ কুটির শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে সংশ্লিষ্টদের ঋণ প্রদানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে এ শিল্প আবারও জেগে উঠবে। কর্মসংস্থান হবে বহু লোকের। এ শিল্পের প্রধান অনুসঙ্গ বাঁশের চাষ বৃদ্ধি পেলে ঝড়-তুফানসহ প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে এলাকার মানুষসহ সম্পদ।
ঐতিহ্যবাহী এ বাঁশ-বেতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন গজারিয়া ইউপির চেয়ারম্যান কাজী গোলাম সারোয়ার। তিনি এ শিল্প রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সহজ এবং স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে ভৈরব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমেদ জানান, বাঁশ-বেত শিল্পসহ হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন কুটির শিল্প রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে যুব উন্নয়ন, সমাজসেবা ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এসব দপ্তরসহ উপজেলা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন ঋণ প্রদান কর্মসূচি থেকে সংশ্লিষ্টরা সহজ শর্তে ও অল্পসুদে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। এই বিষয়ে কারো কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে তাঁর দপ্তর সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানান তিনি।