নানা ‘রোগে আক্রান্ত’ ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
তিন জেলার লক্ষাধিক লোককে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু নানা ‘রোগে আক্রান্ত’ হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি নিজেই।
হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও কর্মী। বেশির ভাগ সময়ই মেলে না সরকারি ওষুধ। ডিজিটাল যুগে পুরোনো অ্যানালগ এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে তিন বছর ধরে। একই সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকা জীবাণুমুক্ত করার অটোক্ল্যাভ যন্ত্র। হাসপাতালে একটি পুরোনো অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও প্রায় সময় সেটি নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বেশির ভাগ সময় অন্ধকারে ঢেকে যায় পুরো হাসপাতাল। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নিরাপত্তারও সমস্যা রয়েছে। মাঝেমধ্যেই রোগীরা দিনদুপুরে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন।
হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৬৫ সালে ভৈরব পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৭৭ সালে এটিকে ৩১ শয্যার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স করা হয়। ১৯৯৪ সালে হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রূপান্তর করা হয়। হাসপাতালটিতে ভৈরব উপজেলার লোকজন ছাড়াও আশপাশের নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার লোকজন স্বাস্থ্যসেবা পেতে এই হাসপাতালে চলে আসেন সহজ যোগাযোগের কারণে। ফলে সব সময় হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকে।
ভৈরব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সূত্রে জানা যায়, ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ২৮ জন। আছেন এর অর্ধেক, ১৪ জন। এই ১৪ জনের মধ্যে আবার দুজন প্রেষণে ঢাকায় কর্মরত। আরেকজন চিকিৎসক আছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। ১১ জন চিকিৎসককে পালা করে বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে হয়।
এ ছাড়া হাসপাতালে টেকনিক্যাল কর্মকর্তা থাকার কথা ২১ জন, কর্মরত আছেন ১৩ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৩০৯টি পদের মধ্যে ৬৪টি পদই শূন্য।
উপজেলার দক্ষিণ চণ্ডীবের এলাকার গৃহিণী জাহানারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পাঁচ টাকায় স্লিপ কেটে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসক দেখিয়ে কাউন্টারে যাওয়ার পর জানা যায়, ওষুধ নেই। এ দৃশ্য প্রায় নিয়মিত বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মধ্যেরচর এলাকার রুহুল মিয়া জানান, তিনি কখনোই এখানকার এক্স-রে ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টের সুবিধা পাননি। এখানে এলেই জানা যায়, এক্স-রে যন্ত্রটি নষ্ট। প্যাথলজিতেও তেমন লোক নেই। তাঁর প্রশ্ন, তাহলে হাসপাতালে এই সব সেবা রাখার অর্থ কী?
শিমুলকান্দির সুষমা রানী জানান, একবার এসে দেখা গেল একজন চিকিৎসককে দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ওষুধ খেলেন। পরে ফলোআপের নির্ধারিত দিনে এসে দেখা গেল ওই চিকিৎসক ছুটিতে অথবা বদলি হয়ে চলে গেছেন। তখন নতুন চিকিৎসকের কাছ থেকে আবার প্রথম থেকে চিকিৎসা শুরু করতে হয়।
উপজেলার শিবপুর গ্রামের শিরিনা বেগম জানান, দরিদ্র পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁদের চিকিৎসা অনেকটাই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সনির্ভর। প্রসূতিদের সেবা থাকায় তাঁরা সন্তান প্রসবের সময় এখানেই আসেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সব বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালের খরচের সঙ্গে এই খরচের ব্যবধান খুব কম বলে তিনি দাবি করেন।
সহজ যোগাযোগ এবং আশপাশে বেশ কয়েকটি দরিদ্র ও প্রত্যন্ত এলাকা থাকায় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাড়তি রোগীর চাপের কথা জানালেন এখানে কর্মরত দুই চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. দিদারুল ইসলাম ও ডা. মুশারাত জাহান। তাঁরা জানান, প্রতিদিন তাঁরা গড়ে কম করে হলেও ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী দেখেন। এতে অনেক সময়ই ভালো সেবাটা রোগীদের দিতে পারছেন না।
প্রসূতি মায়েদের সন্তান প্রসব সেবায় এখানে একটি চমৎকার অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে বলে জানান গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. হরিপদ। তিনি জানান, অস্ত্রোপচার কাজে ব্যবহৃত ছুরি-কাঁচিসহ অন্যান্য জিনিস জীবাণুমুক্ত করার যন্ত্র অটোক্ল্যাভ তিন বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ছুরি-কাঁচি গরম পানিতে ফুটিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। এ ছাড়া শিশু বিভাগের ওয়ার্ডগুলোতে বিছানা সংকট এবং কক্ষের দরজা-জানালার গ্লাস ভেঙে পড়ায় নানাবিধ সমস্যার কথা জানান তিনি।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুরোনো আবাসিক ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে চুন-প্লাস্টার উঠে গেছে। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে আবাসস্থল। ভবনগুলোর ছাদে আগাছা জন্মে ঝোপ-ঝাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানি বাইরে পড়ার আগেই ভবনের ভেতরে পড়ে। দরজা-জানালা ভেঙে বাসাগুলো নিরাপদহীন হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন সেবিকা কল্পনা রানী ও স্টোরকিপার জাহাঙ্গীর আলম।
চিকিৎসক স্বল্পতা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আবাসিক ভবনের সংস্কার, জেনারেটর, সার্জনসহ সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, এক্স-রে ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে কর্তৃপক্ষের সহায়তা চেয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. কে এন এম জাহাঙ্গীর।
দ্রুত চিকিৎসক সংকট নিরসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানিয়ে আরএমও জানান, চিকিৎসক সংকট কেটে গেলে সমস্যার একটা বড় দিক সমাধান হয়ে যাবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা প্রহরীর অভাবে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রায়ই এখানে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে বলে জানান তিনি। স্থানীয় বখাটে ও মাদকসেবীরা আবাসিক এলাকায় ঢুকে নানা সমস্যা তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।