বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, আসামি পুলিশকে খুঁজে পায়নি পুলিশ

নোয়াখালীতে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। মো. নিজাম উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তি পুলিশের স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্বরত।
এদিকে ঘটনার পর ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন। সেই মামলায় আদালত আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন। কিন্তু গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হাতে পেয়েও স্থানীয় সুধারাম থানার পুলিশ সেই আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি বলে অভিযোগ তরুণীর।
এ ছাড়া আসামি এখনো পুলিশের চাকরিতে কর্মরত আছেন এবং নানা রকমের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী।
তরুণী জানান, ঘটনার পরে গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। ওই পুলিশ সদস্যের পরিবার সালিসই করতে দেয়নি। অপরদিকে লোকলজ্জার ভয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে তাঁকে।
বিয়ের প্রলোভনে যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা
ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী এনটিভি অনলাইনকে জানান, গত ২ জুলাই নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছেন তিনি। মামলা নম্বর ৯৪৩।
মামলার আরজি থেকে জানা যায়, ওই তরুণী নোয়াখালীর সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত পাঠাগারের একজন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই এলাকায় কাজ করতে গিয়ে ২০১২ সাল থেকে নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্কের পরে তরুণী নিজামকে বিয়ের কথা বলেন। কিন্তু নিজাম বিয়েতে রাজি হননি। পরে তরুণীকে আশ্বস্ত করে বলেন, দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনা করে পারিবারিকভাবেই তাঁদের বিয়ে হবে।
এর কিছুদিন পর ওই তরুণী নিজাম উদ্দিনকে আবার বিয়ের জন্য চাপ দিলে তিনি জানান, সরকারি চাকরি পেলে তবেই বিয়ে করবেন তিনি। এভাবেই চলতে থাকে কয়েক বছর। অবশেষে ২০১৭ সালে পুলিশে চাকরি হয় নিজাম উদ্দিনের। এ পর্যায়ে নিজাম জানান, প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে যোগ দিয়েই তিনি বিয়ে করবেন। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে গ্রামে ফিরে আসেন নিজাম।
গত ৪ মে রাত আনুমানিক ৮টার দিকে নিজাম উদ্দিন ওই তরুণীর বাড়িতে যান। এ সময় ওই তরুণীর বাবা-মা বাড়িতে ছিলেন না। সেই সুযোগে নিজাম ওই তরুণীকে একা পেয়ে পবিত্র কোরআন শরিফ ছুঁয়ে তাঁকে বিয়ের আশ্বাস দেন ও ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ করেন তরুণী।
এরপর নিজাম চাকরিতে যোগ দিতে গত ৭ মে তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে চাকরিতে যোগ দিয়ে একই দিনে ওই তরুণীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দেন ছুটিতে বাড়িতে ফিরে বিয়ে করার।
কিন্তু ওই তরুণী বাড়িতে ফেরার পরে নিজাম উদ্দিন তাঁর সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
তরুণীর দাবি, প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তিনি গত ২৭ জুন নিজাম উদ্দিনের কর্মস্থল এসপিবিএন ২-এর উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে যান। সেখানে এসপিবিএন ২-এর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিযোগ শোনে। এরপর নিজামকে ডেকে তাঁর বক্তব্যও শোনে। এসপিবিএন-২ কর্তৃপক্ষ নিজামকে ১০ দিনের ছুটি দিয়ে বিষয়টি স্থানীয় ও সামাজিকভাবে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়।
তরুণী আরো জানান, এরপর নিজাম উদ্দিন ছুটিতে বাড়িতে আসার পর গত ৩০ জুলাই তাঁর বাড়িতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, সদস্যসহ স্থানীয় কয়েকজন মিলে একটি সালিসে বসেন। ওই সালিসে নিজাম উদ্দিন ও তরুণীর বক্তব্য শোনেন সবাই। কিন্তু সালিসে কোনো সমাধান হয়নি। এরপর ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য তিনি আদালতে মামলা করেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কিন্তু আসামিকে খুঁজে পায়নি পুলিশ
নির্যাতিত তরুণী গত ২ জুলাই মামলা করার পর গত ২০ আগস্ট আদালত আসামিকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন। সেই পরোয়ানায় দেখা যায়, আদালত আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পরেও আসামিকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানায় পুলিশ। তরুণীর অভিযোগ, কোনো বিশেষ কারণে পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। এরপর আসামি প্রথমে হাইকোর্ট, পরে নিম্ন আদালত থেকে জামিন নেন।
ঘটনা সম্পর্কে নিজাম উদ্দিন যা বলেন
অপরদিকে পুরো বিষয়টিই অস্বীকার করেছেন পুলিশ কনস্টেবল নিজাম উদ্দিন। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, তাঁকে ফাঁসানোর জন্য এই মিথ্যা অভিযোগ ও মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। ওই তরুণীর সঙ্গে তিনি মোবাইলে বেশ কিছু দিন কথা বলেছেন। তবে তাঁর সঙ্গে প্রেম বা ধর্ষণ করেননি। মামলার পর গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন।
ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যা বলেন
ধর্ষণ ও এরপর এ বিষয়ে সালিসের কথা জানতে চাইলে বিনোদপুর ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বাবলু এনটিভি অনলাইনকে জানান, ঘটনাটি মীমাংসার জন্য তিনি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রওশন আক্তার লাকীকে বলেছিলেন। কথা ছিল সালিসের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান হবে। কিন্তু প্রথম দিনের সালিসে বিষয়টির সমাধান না হওয়ায় ইউপি কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে আবার বসার কথা হয়। এর মধ্যেই অভিযোগকারী নারী ছেলের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। আর বিষয়টি নিয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি হলে তিনি সমাধানে দুই পক্ষকে ডেকেছিলেন। ছেলেপক্ষের লোকজন হাজির হলেও মেয়েপক্ষের কেউ না আসায় সালিসটির মীমাংসা হয়নি।
বাবলু আরো জানান, এ ঘটনার কিছুদিন পরে তিনি জানতে পারেন মেয়েটি আদালতে একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা জামিনের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান।
প্রথম দিনের সালিসে উপস্থিত বিনোদপুর ইউপির সংরক্ষিত মহিলা সদস্য রওশন আক্তার লাকী এনটিভি অনলাইনকে জানান, সালিসে মেয়েটি প্রমাণ করতে পারেননি যে তাঁর সঙ্গে ওই ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তবে তাঁরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন ছেলেটি। এবং ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রেম ছিল তা প্রমাণিত হয়নি।
লাকী জানান, এরপর মেয়েটি হঠাৎ ছেলের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। আর এই ঘটনা নিয়ে চেয়ারম্যান ও স্থানীয়রা একটি সালিস ডাকেন কিন্তু সেখানে মেয়ের পরিবারের কেউ হাজির হননি।
এনটিভি অনলাইনকে লাকী আরো বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা। কোনো ছেলে কোনো মেয়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করতে পারে-এমন ঘটনা আপনারা শুনেছেন কখনো। সম্পূর্ণভাবে ছেলেটিকে ফাঁসানোর জন্য মেয়েটি এমন কাজ করছে।’
পুলিশের ভাষ্য
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ওই তরুণী আদালতে একটি মামলা করেছেন। আর মামলা দায়ের করার পরে আদালত থেকে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছিল। কিন্তু আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন। পরে নিম্ন আদালতে উপস্থিত হয়েও তিনি জামিন নিয়েছেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার কতদিন পর আসামি জামিন নিয়েছেন আর এতদিনেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘এটা সঠিকভাবে বলতে পারছি না। কাগজপত্র দেখে তারপরেই বিষয়টি সম্পর্কে জানাতে পারব।’
এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য এসপিবিএনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।