কিশোরগঞ্জে জমে উঠেছে ঢাকের হাট
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে জমে উঠেছে ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। বলা হয়, বাংলাদেশে এটিই একমাত্র ঢাকের হাট। ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলে প্রথম ঢাকের হাটের সুচনা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শুরুর তিন দিন আগে এই হাট শুরু হয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও দুর্গাপূজা উপলক্ষে কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরান বাজারে বুধবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। পূজা উপলক্ষে নির্মিত মণ্ডপে বাদ্য-বাজনা বাজানোর রীতি থেকেই ঢাকের হাটের সূচনা।
এই হাটে বাদ্য-বাজনা নিয়ে বাদক দল যেমন হাজির হয়, তেমনি পূজামণ্ডপের আয়োজকরাও বাদকদলের খোঁজে হাজির হন এখানে। এই হাটে কোনো বাদ্য-বাজনা কেনাবেচা হয় না। শুধু মণ্ডপে বাজানোর জন্য টাকার বিনিময়ে বাদকদল ভাড়ায় নেওয়া যায়। ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে দুর্গোৎসব শুরুর আগ পর্যন্ত তিনদিন ধরে চলে এই হাট।
পূজা উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় চার শতাধিক বাদক নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এরই মধ্যে হাজির হয়েছেন ঢাকের হাটে। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঢাক, ঢোল, ড্রাম, করতাল, খঞ্জনা, সানাই, কর্নেট, কাঁসি, মঞ্জুরি, ঝনঝনি ও নানা জাতের বাঁশি উল্লেখযোগ্য। নিজ নিজ মণ্ডপে বাদ্য বাজানোর জন্য পূজার আয়োজকরাও বিভিন্ন জেলা থেকে ছুটে আসেন কটিয়াদীর ঢাকের হাটে।
বাদ্যবাদক দলের খোঁজে আসা পূজা আয়োজকদের মন জয় করতে চলছে অবিরাম প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের কসরত চালিয়ে যাচ্ছেন বাদকদলের সদস্যরা। এর ফলে একই সঙ্গে বেজে চলছে ঢাক, ঢোল, ড্রাম, করতাল, খঞ্জনা, কর্নেট, কাঁসি, ঝনঝনি ও নানা জাতের বাঁশি। একসঙ্গে অনেক বাদকদলের একত্রে বাদ্য পরিবেশনার সুর মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে পড়েছে এখানকার পরিবেশ।
হাট জমে ওঠায় এরই মধ্যে বিভিন্ন মণ্ডপের নেতারা হাটে বাদকদের বাজানো দেখছেন। পারিশ্রমিকের বনিবনা হলে এখান থেকে বাদকরা দল নিয়ে চলে যাবেন মণ্ডপে মণ্ডপে। ঢাকের হাটে বাদকদল থাকা-খাওয়া ছাড়াই দশমী পর্যন্ত ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক হাঁকছেন।
মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের জিতেন্দ্র দাস ২০ বছর ধরে এই হাটে আসেন। তাঁর পাঁচজনের দলের জন্য তিনি ৮০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছেন।
১০ বছর ধরে এই হাটে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাশীনগর থেকে আসা মন্টু ঋষি। তিনি ১০ সদস্যসের তাঁর বাদকদলের জন্য এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছেন।
নরসিংদীর আবদুল আজিজের ১১ সদস্যের বাদকদলের চাহিদা এক লাখ ১০ হাজার টাকা। তিনি ৩০ বছর ধরে এই ঢাকের হাটে আসেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার শুরুতেই এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কটিয়াদীর ঢাকের হাটে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। এই সুযোগে স্থানীয় বাসিন্দারাও বিনে পয়সায় বাদ্য-বাজনার সুরধ্বনি উপভোগ করতে ভিড় জমাচ্ছেন ঢাকের হাটে।
কটিয়াদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. মতিউর রহমান খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঐতিহ্যবাহী এই হাট রক্ষায় তত্ত্বাবধান করে আসছে। এখানে আগত ঢাকিদের সুযোগ-সুবিধার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
কটিয়াদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সিরাজুল সালেহীন রাহাত বলেন, ‘দেশের একমাত্র ঢাকের এই হাট আমাদের ঐতিহ্য। এটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই।’
কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাব আইন উদ্দিন জানান, ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট নিয়ে আমরা কটিয়াদীবাসী গর্বিত। সম্ভবত দেশে এটাই একমাত্র ঢাকের হাট। সকল বাদ্যযন্ত্রের একযোগে পরিবেশনা করায় হাটে এক অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি হয়। যার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না।