তিন বছরেও পরিচয় মেলেনি ২১ লাশের
মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলার রিজিয়া বেগমের দরিদ্র সংসারে পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান মিজানুর ছিল পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ২০১৪ সালে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন শেষে ঢাকায় ফেরার পথে লঞ্চডুবিতে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ মারা যান মিজানুর। সেই থেকে ছেলে ও তাঁর পরিবারের ছবিই এখন রিজিয়া বেগমের সঙ্গী।
দুর্ঘটনায় মিজানুর, তাঁর স্ত্রী রোকসানা বেগম, আড়াই বছর বয়সের ছেলে মাহিন ও ১১ বছর বয়সী মেয়ে মিলি মারা যায়। এর মধ্যে তিনজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছে তাদের মেয়ে। ছেলে, নাতি-নাতনির শোকে কিছুদিন পরই মারা যান মিজানুরের বাবা।
পাশের ইউনিয়ন সন্ন্যাসীরচরের ফরহাদের পরিণতি আরো ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের চার সদস্যের কারোরই লাশ পাওয়া যায়নি। আর এই অজুহাতে নিখোঁজ অর্ধশতাধিক পরিবারের কাউকেই দেওয়া হয়নি ঘোষিত অনুদান। অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে ২১ জনের লাশ দাফন হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট হলেও এর ফলাফল জানে না ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
এ ছাড়া আজও সন্ধান মেলেনি লঞ্চটির। নিহত ৪৯ জনের মধ্যে অজ্ঞাত হিসেবে ২১ জনের লাশ দাফন হওয়ায় মাত্র ২৮ জনের পরিবার অনুদান পেয়েছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে নিহত ও নিখোঁজ পরিবারগুলোর অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝাই আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের শিবচরের কাওরাকান্দি ঘাট থেকে পিনাক-৬ লঞ্চটি উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মাওয়ার অংশে ডুবে যায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২৮টি লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ২১ জনকে শিবচর পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছে আরো ৫৩ জন। তবে বেসরকারি হিসাব মতে অন্তত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে।
নিখোঁজদের পরিবারে চলছে এখনো শোকের ছায়া। এই দুর্ঘটনায় অনেকেই স্বপরিবারে নিহত ও নিখোঁজ হয়েছে।
পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবিতে শিবচর পৌরসভা এলাকার নুরুল হক মিয়ার ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ে- নুসরাত জাহান হিরা ও রাজধানীর বীরশ্রেষ্ট নুর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা এবং তাঁর খালাতো বোন চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী শরিয়তপুরে গঙ্গানগর এলাকার জান্নাতুল নাঈম লাখি মারা যান। তবে তাদের মধ্যে দুইজনের লাশ পাওয়া গেছে। একজন এখনো নিখোঁজ। লঞ্চে উঠার আগে তিন বোনের বিশ্ব কাঁপানো সেলফি এখন এই পরিবারের কাছে শুধুই একটি ছবি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লঞ্চ ডুবির ঘটনায় যেসব পরিবারে সদস্যরা এখনো নিখোঁজ আছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি সহায়তা। কেউই খোঁজ নেয়নি তাদের। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে ওই পরিবারগুলোকে।
যদিও দুর্ঘটনার পর নিহতদের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে ও পরবর্তী সময়ে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। ঘটনার পর লৌহজং ও শিবচরে স্থাপন করা হয় অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্র। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। লৌহজং থানায় বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে চারটি মামলা করা হয়।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় পরিবারের চার সদস্যকে হারানো বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের সংসারে চারজন মারা গেছে ওই লঞ্চে। তিনজনের লাশ পাইছি। নাতনির লাশ আজো পাই নাই। এই ছেলেই ছিল আমার সংসারের আলো। ওর শোকে শোকে ওর বাপও কয়দিন পরই মারা গেছে। আমি এহন জ্যান্ত লাশ।’
স্বপরিবারে নিখোঁজ ফরহাদের ছোট ভাই শিশু মিয়া বলেন,‘চারটা লাশের মধ্যে একটা লাশ পাইলেও মনডারে সান্তনা দিতে পারতাম। আর সরকার টাকাতো দূরে থাক একটা খবরও নেয় নাই।’
অজ্ঞাত ২১ লাশের ব্যাপারে শিবচর পৌরসভার মেয়র আওলাদ হোসেন খান বলেন, অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে ২১ জনের লাশ পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ লাশগুলোর ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে গত তিন বছরেও কেউ লাশের পরিচয়ের সন্ধানে আসেননি। যদি কেউ আসে তবে পরিবারের কাছে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হবে।
এ বিষয়ে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)ইমরান আহমেদ বলেন, পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির পরে সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই, তাই নিখোঁজ হিসেবে আবেদনকারী কোনো পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়নি।
এদিকে,এই দুর্ঘটনার পরে ওই রুটে লঞ্চ সংখ্যা না বাড়িয়ে লঞ্চ আকারে বড় করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাঠালবাড়ি লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা বাদশা চৌকিদার। যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে নৌপথে কঠোর নজরদারির দাবি যাত্রীদের।