ভাটার সময় আঘাত, জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় রক্ষা
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ যখন সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করে, তখন ছিল ভাটার সময়। আর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় উপকূলে ব্যাপক হারে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।
গতকাল মঙ্গলবারের এ ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার, রাঙামাটি ও ভোলায় আটজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এ ছাড়া উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতি হয়েছে। কোথাও কোথাও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সংযোগও।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। সেখানেই মারা গেছে পাঁচজন। আহত হয়েছে ৬০ জনের মতো। তবে ঘূর্ণিঝড়টির গতি কম থাকায় এবং এটি আঘাত হানার আগেই কক্সবাজারের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা লোকজনকে যথাযথভাবে সতর্কসংকেত দেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির কম হয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলায় ১৭ হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩৫ হাজার। সব মিলিয়ে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫২ হাজার ঘরবাড়ি।
এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন ১১০ টন চাল ও নগদ নয় লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দিয়েছে। এ ছাড়া কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া উপজেলায় ৭০০ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী, তিন হাজার কেজি চিড়া, ২০০ কেজি গুড় বিতরণ করা হয়েছে। পাঁচ হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নৌবাহিনীর মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ঝড়টি দীর্ঘকালীন ধরে আঘাত হেনেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। এই দ্বীপে সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে গতকাল সকাল ৯টা-১০টা পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। এ কারণে দ্বীপটিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। শিগগির সব তথ্য জানা সম্ভব হবে।
ঝড়ের তাণ্ডবে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া ইউনিয়ন, উখিয়ার জালিয়া পালং, কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডি, পোকখালী, মহেশখালী দ্বীপের ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া দ্বীপের উত্তর ধুরুং, আলী আকবর ডেইল ও ধুরুং, পেকুয়া উপজেলার মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়ন এবং চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।
বিধ্বস্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপ
সেন্টমার্টিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে সোমবার দিবাগত রাত ৩টার পর থেকেই। মোবাইল সংযোগ থাকাকালীন দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, সোমবার রাত ১১টা থেকেই মূলত দ্বীপে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। মধ্যরাত থেকে দমকা হাওয়ার গতি বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ১২০/১৩৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় আঘাত হানে দ্বীপে। প্রচণ্ড ঝড়ে দ্বীপের অনেক ঘরবাড়ি ও গাছপালা উপড়ে যায়।
দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ ঝড়ের একদিন আগেই আটকা পড়েন টেকনাফে। তিনি সেখান থেকে জানান, দ্বীপের সাড়ে আট হাজার বাসিন্দার ঘর রয়েছে এক হাজার ৩৫৪টি। এসব বসতির মধ্যে পাঁচ শতাধিক সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত আর আড়াই শতাধিক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ঝড়ের তাণ্ডবে দ্বীপের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলেরা। ঝড়ে বালুচরে আছড়ে পড়ে কমপক্ষে শতাধিক মাছ ধরার নৌকা ক্ষতি হয়েছে। তিন দিন ধরে টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দ্বীপের লোকজনও খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছেন।
গাছপালা উপড়ে ব্যাহত যোগাযোগ
কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে গাছ ভেঙে গতকাল কয়েক ঘণ্টা ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় সড়ক বিভাগের কর্মীরা সড়কের উপড়ে পড়া গাছ কেটে যান চলাচলের উপযোগী করে দেন। চকরিয়া-পেকুয়া ও মহেশখালী দ্বীপের অভ্যন্তরীণ সড়কেও একই সমস্যা দেখা দেয় সাময়িক সময়ের জন্য।
‘প্যারাবন নিধন ক্ষতির কারণ’
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’য় কক্সবাজারের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুতুবদিয়া এবং মহেশখালী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে মহেশখালী দ্বীপের কুতুবজোম, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ী ইউনিয়নে।
অন্যদিকে, কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল, উত্তর ধুরং ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নেও একই চিত্র। মহেশখালী দ্বীপের বাসিন্দা এবং জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ জানান, এ দুই দ্বীপের বেড়িবাঁধের পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় বন বিভাগের সৃজিত বনায়ন কেটে লবণ ও চিংড়ি চাষ করার কারণেই ঝড়ের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।
লণ্ডভণ্ড রোহিঙ্গা বস্তি
ঘূর্ণিঝড়ে উখিয়া ও টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালী, লেদা ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বস্তিও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঝড়ের তাণ্ডবে চারটি শিবিরের কমপক্ষে সাত হাজার ঝুপড়িঘর ধসে পড়েছে। এ কারণে অনেক রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, কুতুপালংয়ে প্রায় ১২ হাজার রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা রয়েছে। এদের মধ্যে সহস্রাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রেড ক্রিসেন্ট এসব পরিবারকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে কুতুপালং নতুন বস্তির প্রায় দুই হাজার ঝুপড়িঘর বাতাসের ঝাপটায় তছনছ হয়ে গেছে। এমনকি ঝুপড়ি-ঘরগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব গৃহহীন পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিনযাপন করছে। টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরেও এ রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
খোলা আকাশের নিচে পরিবার
‘মোরা’য় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। প্রায় আড়াই ঘণ্টার তাণ্ডবে পুরো শাহপরীর দ্বীপ পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। মুহূর্তে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বড়বড় গাছপালা উপড়ে পড়ে। স্থানীয়দের মতে, গত দেড় যুগে তাঁরা প্রকৃতির এমন ধ্বংসলীলা দেখেনি।
শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা সোলতান আহমদ জানান, এবারের ঘূর্ণিঝড়ে শাহপরীর দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন কোনো ঘর নেই। তাঁর মতে, দ্বীপের বাসিন্দাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক জাহেদ হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড়ে শাহপরীর দ্বীপে অন্তত ১০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দ্বীপের অনেক বাসিন্দা অর্থ সংকটে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত বা সংস্কার করতে পারেননি। তাই মানুষের কাছে দ্রুত ত্রাণ ও অর্থ সহায়তার দাবি জানান তিনি।