‘সবাই আসে বিকৃত মুখ দেখতে, কেউ সাহায্য দেয় না’
সুন্দরবনে বাঘের থাবায় মুখের বেশির ভাগ অংশ বিকৃত হয়ে গেছে। সেই বিকৃত অংশ নিয়েই ২১ বছর ধরে মুখে কাপড় পেঁচিয়ে ব্যবসা করছেন। এটা না করলে পরিবারের সবাইকে উপোষ থাকতে হবে। নিজের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে।
হাসমত সরদার নামের ওই ব্যক্তির বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালাক্ষী গ্রামে। বাঘের থাবায় বাঁচলেও জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে তাঁকে।
হাসমত বলেন, ‘আমার বাঘে খাওয়া বিকৃত মুখ দেখতে অনেকেই আসে, কেউ সাহায্য দেয় না। আমি মানুষকে এই বিকৃত মুখ দেখাতে চাই না। মুখ দেখাতে নিজেই কষ্ট পাই। শিশুরা ভয় পায় বলে কাপড় দিয়ে মুখের এক পাশ ঢেকে রাখি সব সময়।’
হাসমতের বাপ-দাদা সুন্দরবনের কাঠ, গোলপাতা, মধু সংগ্রহ এবং মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে তার ভাইয়েরাও আসেন সেই পেশায়। ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। ভাইদের সঙ্গে ১৮ বছরের যুবক হাসমত যান সুন্দরবনে। উদ্দেশ্য ছিল মাছ ধরা। বনের কাঁচিকাটা খালে মাছ ধরা শেষে ওই দিন সন্ধ্যায় নৌকায় ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা তিন ভাই। রাতে হঠাৎ একটি বাঘ হামলা চালায় তাঁদের নৌকায়। বাঘটি প্রথম থাবা বসায় হাসমতের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে পাশে থাকা দুই ভাই লাঠির আঘাতে বাঘ থেকে কোনো মতে ভাইকে বাঁচাতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে হাসমতের মুখের একটি অংশের মাংস তুলে নেয় বাঘটি। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাপ-দাদার সব জমি বিক্রি করে চিকিৎসা চলে। মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করা হলেও আগের অবস্থায় আর ফিরতে পারেননি তিনি।
হাসমত জানান, এখন তাঁর বয়স ৩৯ বছর। সংসারে পাঁচজন সদস্য। তাঁদের খাবার, দুই ছেলে, এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। এ ছাড়া নিজের ওষুধ কিনতেও অনেক অর্থের প্রয়োজন। ওষুধ না খেলে মুখে প্রচণ্ড যন্ত্রণা করে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।
তাই হাসমত এখন প্রতিদিন ভোরে বাড়ির পাশে শ্যামনগরের নোয়াবেকি বাজারে যান। পাইকারি বাজার থেকে বাকিতে মাছ কেনেন। দিনভর তা বিক্রি করে মহাজনের টাকা পরিশোধ করেন। ব্যবসা করে যা লাভ থাকে, তা দিয়েই চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফেরেন।
বাবার ১০ কাঠা জমিতে তাঁদের সাত ভাইয়ের বসবাস। নিজের ঘর ছিল না। কিছু দিন আগে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে দোচালা ঘর তুলেছেন। ওই টাকা এখনো পরিশোধ হয়নি হাসমতের। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তিনি।
হাসমতের আক্ষেপ, সরকার তাঁর চিকিৎসাসহ অন্য কোনো সহায়তায় এগিয়ে এলো না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও সহায়তার হাত বাড়ায়নি। মানুষ শুধু তাঁর ছবি তুলতে তাঁর কাছে আসে।