পানির মাঝে পানির আকাল

‘লালন মরলো জলপিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা’ - দেশের পশ্চিম উপকূলের বাসিন্দাদের অবস্থা মরমি সাধক লালন ফকিরের এ গানের কথার মতোই। এখানে এখনো আছে অনেক নদী, তবু দিন দিন বাড়ছে সুপেয় পানির অভাব।
দেশের পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে শুরু করে পূর্ব দিকের বরগুনার কলাপাড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় পান ও ব্যবহারযোগ্য পানির আকাল বেড়েই চলেছে। এসব এলাকায় বেশ কিছু জায়গায় গভীর নলকূপে থেকেও খাবার ও ব্যবহারযোগ্য নিরাপদ পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় ১৩টি জেলার মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় সুপেয় পানির পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে খারাপ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, খুলনার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই এলাকাটি ব-দ্বীপের নিম্নভাগে হওয়ায় ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটাদানার বালু বা পলিমাটির পরিবর্তে নদীবাহিত অতি সুক্ষ্মদানার বালু ও পলি বেশি দেখা যায়। এ কারণে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভেও পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলে ৯০০ থেকে এক হাজার ফুট গভীরে কখনো কখনো সুপেয় পানি পাওয়া যায়। খুলনার পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ; সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা; বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা; পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া; বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না।’
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এ অঞ্চলে মানুষের বসতি শুরুর সময় থেকেই এখানে নিরাপদ পানির সমস্যা ছিল। কারণ, এলাকাটি উপকূলীয় জলাভূমি এবং ঈষৎ নোনা পানির এলাকা (Brakish water zone)। এই এলাকার সাগরসংলগ্ন নদী ও জলাভূমি ২৪ ঘণ্টায় চারবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। এলাকাটি গাঙ্গেয় প্লাবণ ভূমি। অতীতে অঞ্চলটি গঙ্গা নদীর সুমিষ্ট ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ছিল মিষ্টি ও নোনা পানির মধ্যে একটি ভারসাম্য অবস্থা। যে কারণে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেলেও পুকুর ও জলাভূমিগুলো সব সময় মিষ্টি পানির সংরক্ষণস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মানুষ পুকুরের ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করত।
সুপেয় পানির জন্য হজরত খানজাহান আলী (দ.) ও তাঁর অনুসারীরা এ অঞ্চলে বড় বড় দীঘি খনন করেছিলেন। দীঘিগুলো এলাকাবাসীর জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের উৎস ছিল। সেই ধারা পরে টিকিয়ে রাখা যায়নি।
মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) গবেষণা জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরবাহিত নদীগুলোর নোনার মাত্রা আগে থেকে অনেক বেড়েছে এবং বেশি সময় দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বছর দশেক আগেও এই অঞ্চলের নদীগুলোয় নোনার মাত্রা বাড়ত এপ্রিল থেকে মে-জুন মাসে। এখন কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, ভৈরব, রূপসা, বলেশ্বর, কচা, পায়রা, বিষখালী প্রভৃতি নদীতে নোনা পানি আসে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকে। আর ভারী বৃষ্টি না হলে সেই নোনার মাত্রা কমে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৃষ্টি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে বেশি হওয়ায় নদীর নোনা কমে সহনশীল পর্যায়ে আসতে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে গত বছর (২০১৪) ছিল ব্যতিক্রম। গতবারে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা কম ছিল।
এসআরডিআইর জরিপ অনুযায়ী, গত এক দশকে নোনাক্রান্ত ভূমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় নোনাক্রান্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মনিরুল ইসলামের মতে, ব্যাপকমাত্রায় নোনা পানির বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে কোথাও কোথাও জমিতে সারা বছর, কোথাও কোথাও বছরের বেশির ভাগ সময় নোনা পানি আটকে রাখা হয়। এতে ভূমি ও পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার খুলনার অন্যতম সংগঠক মেহেদী হাসান বলেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করে সরবরাহ করাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে আমরা আর্সেনিকের বিপদে পড়েছি। উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের ভূপৃষ্ঠের পানি (নদী, পুকুর, দীঘি) ব্যবহার করার কৌশল শিখতে হবে এবং ব্যবহার বাড়াতে হবে। আগে এই অঞ্চলে পুকুরের পানিই ছিল ভরসা। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় নোনা পানির বাগদা চিংড়ি সেই উৎসগুলো খেয়ে ফেলেছে। সরকারের উচিত, সুপেয় পানি সরবাহের লক্ষ্য পুকুরের ওপর জোর দেওয়া।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, পশ্চিম উপকূলে পানি সংকটের অবস্থা আমরা শহরবাসী গরমকালে টের পাই। এ বছর এখনি খুলনা মহানগরীর অনেক গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। এর কারণ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া।’ তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরনের (রিচার্জ) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না।’ তিনি এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পানি ভূগর্ভে যাওয়ার দুটি উপায়। একটি বৃষ্টির পানি আর অন্যটি ভূ-উপরিভাগের জমে থাকা (পুকুর, খাল, নদী প্রভৃতি) পানি চুইয়ে চুইয়ে যাওয়া। উপকূলীয় এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে কম মাত্রায় প্রবেশ করে। সে ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ভূ-উপরিভাগের জমে থাকা পানি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি খুলনা শহরসহ উপকূলীয় এলাকার পুকুরগুলো প্রায় সবই শুকিয়ে ফেলা হয়েছে।’ ভবিষ্যতের জন্য বিপদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সাধারণত সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট গভীরতায় খুলনা শহরবাসীর জন্য পানযোগ্য পানি সংগৃহীত হচ্ছে। এরপরের গভীরতার পানির স্তরটি নোনা পানির। যদি ওই স্তরের নোনা পানি তোলা শুরু হয়, তবে নগরীর ভূগর্ভের পানি নোনাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’