হেলিকপ্টার থেকেও বোরকা পরে নামেন সাহেদ
ঠিক সকাল ৯টা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে সাতক্ষীরা জেলা স্টেডিয়াম থেকে আসা দুটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি তখন। গণমাধ্যমের ক্যামেরাগুলো তাক করা হেলিকপ্টারের দিকে। হঠাৎ দেখা গেল, হেলিকপ্টার থেকে বের হচ্ছেন রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ। এ সময় তাঁর হাতে হাতকড়া, মাথায় হেলম্যাট ও বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা ছিল। পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট ও নীল রঙের শার্টের ওপর কালো রঙের বোরকা।
রিজেন্ট হাসপাতালে ভুয়া করোনা টেস্ট করে প্রতারণার ঘটনায় প্রধান আসামি মো. সাহেদ আজ বুধবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটের দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর সীমান্ত এলাকার বেইলি ব্রিজের নিচ দিয়ে লবঙ্গবতী নদীপথে নৌকায় করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। তিনি চেয়েছিলেন বোরকা পরে লোকচক্ষুর আড়ালে অবৈধপথে ভারতে পাড়ি জমাতে। কিন্তু তিনি পালাতে পারেননি। কারণ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল নয় দিন ধরে। আজ ভোরেই সাহেদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র্যাব যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করে, তখন পালানোর জন্য র্যাব সদস্যদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও করেন সাহেদ। এ কারণে সাহেদের বোরকা ও প্যান্টে কাদা লেগে যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাহেদ গোপনে দেশত্যাগ করতে দেবহাটা সীমান্তের জিরো পয়েন্টে যান। কিন্তু তিনি দেশত্যাগ করতে পারেননি। কয়েক দিন ধরেই সাহেদ অবৈধপথে দেশত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিটি সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি ছিল। এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন সাহেদ। আর সে কারণেই তিনি বিভিন্ন সময় স্থান বদল করছিলেন।
আজ বুধবার এনটিভি অনলাইনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাসেম, র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ ও র্যাবের সাতক্ষীরা কোম্পানি কমান্ডার বজলুর রশীদ।
সারওয়ার বিন কাসেম বলেন, ‘সাহেদ খুবই ধূর্ত। যাতে করে তাঁকে কেউ চিনতে না পারে, সে জন্য তিনি বোরকা পরে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গ্রেপ্তারের আগে তিনি নিজের জেলা সাতক্ষীরাতে অবস্থান করলেও বাড়িতে যাননি। এ ছাড়া আমরা খবর পেয়েছিলাম, তিনি অন্য সীমান্ত দিয়েই দেশত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সতর্ক অবস্থানের কারণে তিনি আর ভারতে চলে যেতে পারেননি। সে জন্য বারবার তাঁর অবস্থানও পরিবর্তন করেছেন।’
র্যাবের সাতক্ষীরা কোম্পানি কমান্ডার বজলুর রশীদ বলেন, ‘সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর বেইলি ব্রিজের দক্ষিণ পাশের লবঙ্গবতী নদীর পাড় থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। নদীর ঠিক ধারে একটি নৌকা রাখা ছিল। ওই নৌকায় উঠে ভারতে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাহেদ। ঠিক সে সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘সাহেদ একজন বড় মাপের প্রতারক। তিনি প্রতারণাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা সাধারণ মানুষের ভাবনার অতীত। মানুষের সঙ্গে নানা ধরনের প্রতারণা করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছে, যা একটি অনন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মানুষ তাকে সারা জীবন ঘৃণার চোখে দেখবে। সাহেদের মামলার তদন্তভার পেতে আমরা ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও জানিয়েছি। আমরা তদন্তে এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সাহেদের দাদা এমদাদুল করিম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এ সময় তাঁরা সাতক্ষীরা মহকুমার দেবহাটায় বসবাস শুরু করেন। পরে তাঁরা সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল কামাননগরে বসবাস করতে থাকেন। সাহেদের মা সাফিয়া করিম সাতক্ষীরা জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান। এর আগে ১৯৯৮ সালে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়াকালে সাহেদ নানা অপরাধ করে ঢাকায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন রিজেন্ট হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গত ৬ জুলাই বিকেল থেকে রাত অবধি উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের মূল কার্যালয়ে প্রথমে অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে অভিযান শেষে হাসপাতালটির মিরপুর শাখায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় হাসপাতালটির আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করা হয়।
এরপর ৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয় র্যাব-১। এ ছাড়া উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয়ও সিলগালা করা হয়। ৭ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সাড়ে চার হাজার করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। একজন কম্পিউটার অপারেটর বসে বসে সাড়ে চার হাজার রিপোর্ট তৈরি করেছেন। মনগড়া রিপোর্ট পজিটিভ-নেগেটিভ দিয়েছেন।
তা ছাড়া মোট ১০ হাজার রোগীর করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। মাত্র চার হাজার ২৬৪টি নমুনা সরকারিভাবে টেস্ট করে রিপোর্ট দেয়। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতারণার কৌশল গ্রহণ করে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারো জ্বর থাকলে তাকে পজিটিভ আর জ্বর না থাকলে নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদান করে।