‘স্বাস্থ্য খাতে মানুষ এখন সিস্টেমের কাছে জিম্মি, ব্যক্তির কাছে নয়’
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনার মূলে আইনের শাসনের অভাব। স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শিক্ষা খাতের অবস্থাও ভয়াবহ বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গতকাল শনিবার রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আইনের সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তাঁরা এই মত জানান। এতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন ও বিশিষ্ট আইনজীবী জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক জোয়ার্দার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী লুবনা ইয়াসমিন।
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘গ্রামে বা মফস্বলের হাসপাতালোতে কোনো চিকিৎসাই হয় না।’
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের উদাহরণ দিয়ে জেড আই খান পান্না বলেন, সেখানে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার মতো কোনো সরঞ্জামই নেই। তদবির করে অন্য কোথাও যেতে ব্যর্থ অনেক দক্ষ চিকিৎসক সেখানে পড়ে আছেন। যাদের তদবিরের জোর বা অর্থের জোর আছে তারা ভালো জায়গায় বদলি করিয়ে নিতে সক্ষম হন। মেডিকেল কলেজগুলোও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একসময় ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সব চিকিৎসা হতো, এখন তাও হয় না। সাধারণ মানুষের জন্য এগুলো সুলভ হলেও, পর্যাপ্ত নয়, উন্নতমানের নয়। যে জন্য মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে। স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত সবকিছুই এখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, এগুলো এখন আর সেবামূলক নেই। মানুষ এখন গোটা সিস্টেমের কাছে জিম্মি, ব্যক্তির কাছে নয়। কারাগারগুলোতেও কোনো চিকিৎসা নেই বলে মন্তব্য করেন জেড আই খান পান্না।
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা-ব্যর্থতা বিরাজমান। বাংলাদেশের সর্বত্র ‘ড্রাইভার মালেকের’ মতো দুর্নীতিবাজ রয়েছে। করোনার মধ্যে সব দেশ যখন কে কার আগে তার নাগরিকদের ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেবে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। জেকেজি, মো. সাহেদ, সাবরিনা, মালেকদের দুর্নীতি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং এটাই গোটা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র। দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। দেশে অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক থাকলেও তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। কিন্তু মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের কেউ অসুস্থ হলে ‘উন্নত চিকিৎসা’র জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
চিকিৎসায় অবহেলা বা গাফেলতির বিচার চাওয়ার জন্য ‘লিগ্যাল স্ট্রাকচারের অভাব লক্ষণীয় বলে মত দেন ড. তৌফিক। তিনি বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কেন্দ্র এবং শাস্তির বিধান রয়েছে। দেশের লিগ্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে ক্লিনিক্যাল নেগলিজ্যান্স এবং মেডিক্যাল ইস্যুগুলোকে দেখভাল করার জন্য আলাদা স্ট্রাকচার দাঁড় করানো না গেলে বের করা যাবে না। কোনটা ক্লিনিক্যাল নেগলিজ্যানস, আর কোনটা মেডিক্যাল এক্সিডেন্ট।
ড. তৌফিক আরো বলেন, “বাংলাদেশে অদক্ষ-অকার্যকর ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল মেকানিজম’ ছাড়া অন্য কিছু নেই। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিএমএ) অন্য যেসব পেশাজীবী সংগঠনগুলো রয়েছে, সেগুলো অনেকটা ট্রেড ইউনিয়নের মতো কাজ করে। তারা কেবল তাদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু নিজেদের পেশার দায়িত্ব বা দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায় না। যদিও তাদের গঠনতন্ত্র বলে ভিন্ন কথা।”