স্ত্রী-সন্তান নয়, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধের দায়িত্ব নিলো পুলিশ
করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময়ে আপনজন দূরে সরে যাচ্ছে। রক্তের বাঁধনও যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে অদৃশ্য ভয়ে। অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতার দাপট কাজে আসছে না। পাশে থাকছে না কেউ। করোনার দাপটে কাবু মানবতা। এরই মাঝে রাস্তা থেকে এক বৃদ্ধকে তুলে নিয়ে, চিকিৎসা করিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাল ঝিনাইদহের পুলিশ।
বৃদ্ধ আশরাফুজ্জামান (৬৩) পড়ে ছিলেন রাস্তার পাশে। তাঁর বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর গ্রামে। দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি বসবাস করতেন সাভারের একটি ভাড়া বাড়িতে।
টানা প্রায় ২০ বছর নিজ গ্রামের স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন আশরাফুজ্জামান। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয় তাঁকে। দুই বছর আগে বাথরুমে পড়ে চলাচলের ক্ষমতা হারিয়েছেন তিনি। এতে করে আয়-রোজগারও কমে যায়। কষ্টেই কাটছিল তাঁর দিনগুলো।
এরই মাঝে চলে আসে করোনাকাল, দুর্যোগের মুহূর্ত। আতঙ্কে দ্বিতীয় স্ত্রী নাসিমা ও ছেলে মনিরুজ্জামান সাভারের ভাড়া বাসায় আশরাফুজ্জামানকে একা ফেলে রেখে চলে যান। আর আশরাফুজ্জামান- যে কিনা হুইল চেয়ারে বন্দি, একা একা চলতেই পারেন না, তিনি এই অবস্থাতেই ২৫ দিন একা ওই বাসায় কাটিয়ে দেন।
একসময় আশরাফুজ্জামানের মনে হয়, তিনি তো এখানে থেকে মারাই যাবেন। অবশেষে বাঁচার আশায়, সাহসে ভর করে গত বুধবার হুইল চেয়ারে করেই বেরিয়ে পড়েন পথে; জীবন-মৃত্যুকে সাথী করে। একা একা একটি পিকআপ ভাড়া করে ঝিনাইদহে চলে আসেন।
ক্লান্ত আশরাফুজ্জামান ভাবলেন, নিজের গ্রামের বাড়িতে গেলে নিশ্চয়ই একটু আশ্রয় মিলবে। কিন্তু বাড়ির চাচাতো ভাইয়েরা আশ্রয় তো দূরের কথা, তাঁকে পিকআপ থেকেই নামতে দেননি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুজ্জামানের মামা। তিনি বেঁচে থাকার আশায় নিয়ে ছুটে যান মামার কাছে। কিন্তু মামাও মুখ ফিরিয়ে নেন, ভাগ্নের জীবন বাঁচানোর আবেদনে সাড়া দেননি।
এদিকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে পঙ্গু অসহায় আশরাফুজ্জামানকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান সাভার থেকে আসা পিকআপচালক। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চালক ঝিনাইদহ-মাগুরা মহাসড়কের গোয়ালপাড়া বাজার এলাকার রাস্তার পাশে আশরাফুজ্জামানকে ফেলে রেখে কৌশলে সটকে পড়েন। একা হয়ে পড়েন আশরাফুজ্জামান, খোলা আকাশের নীচে রাস্তার পাশে।
কেউ আশরাফুজ্জামানের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হুইল চেয়ারে বসে থাকেন তিনি। আর রাত গভীর হতে থাকে। কোনো খাবার নেই। ঠিক এ সময় রইচ উদ্দিন নামের এলাকার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারেন। পরে তিনি স্থানীয় হাটগোপালপুর পুলিশ ক্যাম্পে খবর দেন।
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার করা হয় আশরাফুজ্জামানকে। এর পর তাঁর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অবশেষে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে দুপুরে তাঁকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘করোনা ঝুঁকির মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিনরাত মাঠে-ময়দানে ছুটে বেড়াচ্ছে। অসহায় মানুষের কান্নার জল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তারা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা আশরাফুজ্জামানকে স্বজনরা কেউ গ্রহণ করেননি। অসহায় এ মানুষটির যতদিন অবিভাবক না পাওয়া যায় ততদিন আমরা পাশে থাকব।’ খাদ্য সহায়তাসহ এ ধরনের মানবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিলিথা পারভীন বলেন, ‘আশরাফুজ্জামানের করোনার কোনো উপসর্গ নেই। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তিনি। ঢাকা থেকে এসেছেন বিধায় হাসপাতালে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে তাঁকে।’