সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেই তাকে শায়েস্তা করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আজ শুক্রবার আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

এ সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের গর্বের ও অহংকারের বিষয়। বর্তমান সরকার প্রতিনিয়ত আমাদের সেই অর্জন, আমাদের গর্বের, অহংকারের গৌরবের স্বাধীনতার চেতনা এবং সংবিধানের পবিত্রতাকে লঙ্ঘন করছে, অপমান করছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিভিন্ন তথ্যসূত্র, বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। প্রায় সব মামলার কমন অভিযোগ হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের জন্য তথাকথিত সম্মানহানি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপরাধ। এসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, সরকারি দলের লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে, রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করলে, সরকারের সমালোচনা করলে মামলা করা হয়েছে। মামলার ভয়ে আজ জাতির কণ্ঠরুদ্ধ। বিবেকের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত, যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।”

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১২ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এরই মধ্যে সংবাদপত্র- সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর জন্য সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না। দেশি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই কালো আইন বাতিলের দাবি তুলেছে। বিএনপি শুরু থেকেই বলে এসেছে, এ আইন কালো আইন। এই আইন সংবিধানবিরোধী এবং এই আইন জনগণের কণ্ঠ রোধ করার জন্য সরকারের হাতিয়ার। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই আইন করেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) কার্যকর রয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১০৮টি। এসব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন আর অন্যান্য পেশায় কর্মরত ও সাধারণ মানুষ ১৬০ জন। এই হিসাবে প্রায় ২৫ ভাগ আসামিই হলেন সাংবাদিক। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ২৪, মে-তে ৩১ এবং জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ২১টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আর আর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৬৩টি। ২০১৮ সালে ডিএসএ এবং আইসিটি অ্যাক্ট মিলিয়ে মামলা হয়েছে ৭১টি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এক বছরে মোট মামলা হয়েছে ৬৩টি। আর সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই মামলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি, ১০৮টি।’

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। কারণ, অনেক মামলার খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। তাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তার খোঁজ পায় না। ফলে তাদের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে ঢাকায়। ডিজিটাল এবং তার আগের আইসিটি আইনের সব মামলার হিসাব আছে সেখানে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে মোট ৩২৭টি। জানুয়ারি মাসে মোট মামলা হয়েছে ৮৬টি। এর মধ্যে থানায় ৪১টি ও আদালতে ৪৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে ১১৯টি মামলা। থানায় ৯৫টি ও আদালতে ৩৪টি। মার্চ মাসে মামলা হয়েছে ১২২টি। এর মধ্যে থানায় ৭৫টি ও আদালতে ৩৭টি। আর ২০১৯ সালে মোট মামলা হয়েছে এক হাজার ১৮৯টি। এর মধ্যে থানায় ৭২১টি এবং আদালতে ৪৬৮টি। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন মামলা আছে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৯৫৫টি। এর মধ্যে থানায় করা এক হাজার ৬৬৮টি এবং আদালতে ২৮৭টি। ৫৫টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে। এ আইনের নগ্ন শিকার হয়েছেন অন্যদের মধ্যে ৮৫ বছরের বেশি বয়সের সম্পাদক আসাদউদ্দিন, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল, ব্যবসায়ীসহ অজস্র নিরীহ নাগরিক। আমরা অবিলম্বে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।’