লালবাগের আজিজ হত্যা : একজনের মৃত্যুদণ্ড, আরেকজনের যাবজ্জীবন
রাজধানীর লালবাগের ব্যবসায়ী আবদুল আজিজ চাকলাদার হত্যা মামলায় এক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান আজ সোমবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে সরকার পক্ষে ছিলেন বেলায়েত হোসেন ঢালী এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আবদুল খালেক।
রায়ে এক সময়ের ত্রাস খুলনার এরশাদ শিকদারের সহযোগী আসামি জয়নালের মৃত্যুদণ্ড এবং আরেক আসামি রুস্তম আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরো ছয় মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ ছাড়া এ মামলায় প্রধান আসামি এরশাদ শিকদারের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এবং দ্বিতীয় আসামি লিয়াকত মামলা চলাকালে মারা যাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া মামলার আরো দুই আসামি জামাই ফারুক ও জামাই ইদ্রিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় আদালত তাঁদের মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন। খালাসপ্রাপ্ত দুই আসামি প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি জয়নাল ও রুস্তম আলী পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া এ মামলার তিন নম্বর আসামি একমাত্র রাজসাক্ষী হওয়ায় নুরে আলমকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে। আরো নিখুঁতভাবে তথ্য উপস্থাপন করা উচিত ছিল। এ কারণে দুজন আসামিকে খালাস দিতে হয়েছে। কেননা এ মামলার একমাত্র রাজসাক্ষী নুরে আলম নিজেকে জড়িয়ে সাক্ষী দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই আসামি জামাই ফারুক ও জামাই ইদ্রিসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। এ কারণে তাদের খালাস দিতে হয়েছে।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) বেলায়েত হোসেন ঢালী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এ মামলায় সাতজন আসামি ছিল। তার মধ্যে প্রধান আসামি এরশাদ শিকদার ও লস্কর লিয়াকত মারা যাওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি, দুজনকে খালাস, একজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ মামলার প্রথমে আসামি এবং পরে রাজসাক্ষী হওয়ায় নুরে আলমকে মুক্তি দিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান রায়ের জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রায় প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক গত ১ এপ্রিল রায়ের জন্য নতুন দিন নির্ধারণ করেছিলেন। সেদিন করোনাভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় আর রায় দেওয়া হয়নি। তাই আদালত আজ রায় ঘোষণা করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, রাজধানীর লালাবাগ থানার বাসিন্দা ছিলেন আবদুল আজিজ চাকলাদার। এরশাদ শিকদার আজিজের মাধ্যমে রাজধানীতে বাড়ি ও প্লট কিনেছিলেন। কিন্তু পুলিশের কাছে এসব তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার সন্দেহে ১৯৯৮ সালে ৫ মার্চ খুলনায় ডেকে নিয়েছিলেন এরশাদ শিকদার। আবদুল আজিজ চাকলাদার এক সপ্তাহ পর ফিরে আসবেন বলে বাসায় জানিয়ে যান। কিন্তু বাসায় ফিরে না আসায় আজিজের ভাই বাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে একটি জিডি করেন। পরে নিখোঁজের দেড় বছর পর এরশাদ শিকদার পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ২২টি খুনের কথা স্বীকার করেন। এর মধ্যে আবদুল আজিজও ছিলেন। এরপর তদন্ত শেষে এ ঘটনায় এরশাদ শিকদারসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাটি দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে পড়েছিল। পরে মামলার এক আসামি নুরে আলম রাজসাক্ষী হওয়ায় ঘটনার ২১ বছর পর বিচার কাজ সম্পন্ন হলো।
যেভাবে জামিন পান নুরে আলম
১২টি হত্যাকাণ্ডে এরশাদ শিকদারের সহযোগী ছিলেন তাঁর দেহরক্ষী নুরে আলম। পরে তিনি এসব হত্যা মামলার রাজসাক্ষী হন এবং আদালতে এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তাঁর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে খুলনার জলিল টাওয়ারের মালিকের ম্যানেজার খালিদ হত্যা মামলায় এরশাদ শিকদারের ফাঁসির আদেশ হয়। ওই মামলায় ২০০৪ সালের ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়। এভাবে একে একে ১১টি মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে কারাগারে থেকেই এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন নুরে আলম। বাকি ছিল রাজধানীর লালবাগের আজিজকে অপহরণ করে হত্যার মামলা। পুরাতন মামলা হিসেবে ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট মামলাটি চার মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন।
এর আগে এ মামলায় এরশাদ শিকদারের দেহরক্ষী নুরে আলমকে কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ দেন বিচারক। নুরে আলম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার আজিমপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে ছিলেন।
এদিকে নুরে আলম কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর ছেলে রাফী (১৮) মারা গেছেন এবং স্ত্রী ছেড়ে গেছেন। বাড়ি, জমি এখন কিছুই নেই। তিনি প্রথম জীবনে জাহাজে চাকরি করতেন। সেই চাকরি ছেড়ে এরশাদ শিকদারের দেহরক্ষী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
এরশাদ শিকদারের গ্রেপ্তার ও ফাঁসি কার্যকর
১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হন এরশাদ শিকদার। তখন তাঁর নামে ৪৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর বেশিরভাগই হত্যা মামলা। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তাঁর ফাঁসির আদেশ হয় এবং চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর আবেদন নাকচ করে দেন এবং ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে টুটপাড়া কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।