মারামারির জন্য রিমান্ডে নেওয়ার কী দরকার?
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যাচেষ্টা মামলায় বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ও তাঁর সহযোগী মো. জাহিদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর এ আদেশ দেন।
আজ দুপুর ১২টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তিনতলায় কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ও তাঁর সহযোগী মো. জাহিদকে পুলিশি পাহাড়ায় হাজির করা হয়। এরপর তাঁদের আদালতের লোহাবেষ্টিত কাঁঠগড়ায় রাখা হয়। এ সময় তাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন।
প্রথমে তাঁদের পক্ষে আইনজীবী প্রাণ নাথ রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মারামারির জন্য আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার কী প্রয়োজন? আসামির বিরুদ্ধে তো অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাজা হবে, অন্যথায় খালাস পাবে। রিমান্ড চাওয়ার কিছু নেই। রিমান্ডে নেওয়া হলে হয়রানি ছাড়া কিছুই হবে না।’
আইনজীবী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, রিমান্ডে নেওয়া হলে আসামির অবস্থা কী হবে? মারামারির জন্য যে রিমান্ডে যায় এ ধরনের তো কোনো নজির নেই। তাকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী আরো বলেন, ‘মামলার ভিকটিমকে কে কে মেরেছে, তা এজাহারে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। আমি এখন আসামির জামিন চাচ্ছি না, তবে রিমান্ড বাতিল চাচ্ছি।’
‘র্যাব আসামির বাসায় গিয়ে সকাল-সন্ধ্যা অভিযান চালিয়েছে। আমার (আসামি) কাছে যা পেয়েছে, আর না পেয়েছে, সব মিলিয়ে আমার (আসামি) সাজা হয়েছে। আসামিদের নাম ঠিকানা নতুন করে যাচাই করার কিছু নেই। এ ছাড়া চারজন আসামির দুজন রিমান্ডে আছে। আসামিরা কে কী করেছে সেই কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তাই আসামির রিমান্ড বাতিল চাচ্ছি।’ আদালতে বলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রাণ নাথ।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান বলেন, ‘আসামিকে রিমান্ডে নিলে মামলার মূল রহস্য উৎঘাটন হবে। তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হোক।’ এই আইনজীবী মামলার এজাহারে যা আছে, তা হুবহু আদালতে উপস্থাপন করেছেন।
শুনানি শেষে বিচারক দুই আসামির প্রত্যেককে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন।
শুনানি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রাণ নাথ বলেন, ‘৩৩২ ধারা, ৩৫৩ ধারা কোনো সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি কর্মচারী ছাড়া যদি তাঁর প্রাইভেট কোনো কাজে আসে, সেখানে যদি তাঁর সাথে কোনো লোকের মারামারি বা কোনো কিছু হয়ে থাকে এ ধারায় কোনো মামলা হতে পারে না। সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি এ ধরনের কিছু হয় নাই, সেটা আমরা আদালতকে বলেছি। এটা একটা মারামারির মামলা, চারজন আসামি এখানে গ্রেপ্তার হয়েছে। সেখানে কোনো রিমান্ড হতে পারে না।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘সে সরকারি ব্যক্তি, সে একজন নেভাল অফিসার, সে পরিচয় দিয়েছে, সে একজন লেফটেন্যান্ট নৌবাহিনীর। পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও তাকে এভাবে মারধর করেছে। এটা তো আইনে নাই যে একজন নিরীহ লোককে মারধর করবে বিনা কারণে। এটা তো হতে পারে না, সে সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক।’
এর আগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গতকাল মঙ্গলবার ইরফান ও জাহিদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশফাক রাজীব হাসান।
গত রোববার রাতে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খানকে মারধর ও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পরদিন সোমবার সকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম, এ বি সিদ্দিক দিপু, মো. জাহিদ ও মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো দু-তিনজনকে আসামি করে ধানমণ্ডি থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন ওয়াসিফ আহমদ খান।
মামলার পর গত সোমবার দুপুর থেকে র্যাব সদস্যরা রাজধানীর চকবাজারের ২৬ দেবীদাস ঘাট লেনে ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ী’তে অভিযান চালান। অভিযানে নেতৃত্ব দেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। অভিযান শেষে অবৈধ ওয়াকিটকি ও মাদক রাখার দায়ে ইরফান সেলিম ও তাঁর দেহরক্ষী মো. জাহিদকে এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর রাতে দুজনকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
গত সোমবার সন্ধ্যায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, ইরফান সেলিমের কক্ষ থেকে লাইসেন্সবিহীন বিদেশি অস্ত্র, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া দেহরক্ষী মো. জাহিদের কাছ থেকে ৪০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের ৩৮ থেকে ৪০টি ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে।
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা তাঁদের কাছ থেকে গুলি, হাতকড়া, একটি ড্রোন এবং কন্ট্রোল রুম থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ভেরি হাই সিকিউরিটি সেট (ভিএইচএস) উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। এটা ওয়াকিটকির একটি আধুনিক সংস্করণ। এ ছাড়া ওই বাসায় টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। টর্চার সেলে হাড়, ছুরি, হকিস্টিক ও দড়ি পাওয়া যায়।’
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার একই মামলায় ইরফানের সহযোগী আসামি দিপুকে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই মামলায় সোমবার ইরফান সেলিমের গাড়িচালক মো. মিজানুর রহমানকে একদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।