প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ মো. জিল্লুর রহমানের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ ৯ মার্চ। জন্মবার্ষিকী পালনে তাঁর জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
ভৈরব পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম বাকী বিল্লাহ জানিয়েছেন, জন্মবার্ষিকী পালনে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ যৌথভাবে কোরআন খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। আজ সকালে দলীয় কার্যালয়ে এসব কর্মসূচি পালিত হবে।
সরকারি জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলেজে কেক কাটা, আলোচনা সভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
ভৈরব প্রেসক্লাবের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে কেক কাটা, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যাপক মো. সামসুজ্জামান বাচ্চু।
এ ছাড়া ভৈরব টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল। জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি যমুনা টেলিভিশনের প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক এনটিভির স্টাফ রিপোর্টার মোস্তাফিজ আমিন।
জিল্লুর রহমান ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুর গ্রামের বলাকি মোল্লার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সাত মাসের মাথায় তাঁর মা বাচ্চু বিবি মারা যান। আর নয় বছর বয়সে হারান বাবা, স্বনামধন্য আইনজীবী অবিভক্ত ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য মেহের আলীকে।
অনাথ ও বেদনবিধুর শৈশবে জিল্লুর রহমান বেড়ে ওঠেন দাদা হাজি মোজাফফর মুন্সী মোল্লা ও নানা-নানির আশ্রয়ে। তাঁর নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈতাতলা এলাকায়। তিনি ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুরপাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫৩ সালে জিল্লুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৬ সালে জিল্লুর রহমান কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় জিল্লুর রহমান ভৈরবের জনগণের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে থাকে ভৈরবের মানুষের কাছে। তৎকালীন ভৈরব অঞ্চলের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে তাঁর নাম প্রচার হতে থাকে। সে সময়ে দাঁড়িপাল্লার বিরুদ্ধে নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
১৯৭০ সালে জিল্লুর রহমান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। জিল্লুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান ও তাঁর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
জিল্লুর রহমান দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান। এর আগে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর তিনি তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আহত হন আইভী রহমান। ২৪ আগস্ট তিনি মারা যান। তাঁদের একমাত্র ছেলে নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্য। পাপন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি।