পরিবার খুঁজছিল শিশু সজীবকে, পুলিশ দিল এনজিওর হাতে!
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০। বিকেল ৩টা। শিশু সজীব (১০) বন্ধুদের সঙ্গে খেলার জন্য বের হয় গাজীপুরের টঙ্গীর শিলমুন এলাকার বাসা থেকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পরও বাসায় ফেরেনি সজীব। সন্ধ্যার পর থেকে খুঁজতে শুরু করে তার পরিবার। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সজীবের সন্ধান মেলেনি। এদিকে নাতিকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসাচ্ছেন নানি নূর জাহান।
ঘটনার পাঁচ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার সজীবকে দেখা যায় ঢাকা রেলওয়ে থানায়। কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় ভিক্ষা করার অপরাধে তাকে আটক করে পুলিশ। তবে শুধু সজীব নয়, মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও ভিক্ষা করার অপরাধে সজীবসহ ১৫ শিশুকে থানায় আটক অবস্থায় দেখা যায়। পরে সবার ঠিকানা হয় শিশু উন্নয়ন ও অধিকার বাস্তবায়নকারী সংস্থা লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে (লিডো)।
পুলিশ বলছে, মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও ভিক্ষা করার কারণে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সজীবসহ মোট ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের অবস্থার উন্নতি ও জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা দিতে তাদের লিডোতে দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এরাই একদিন বড় ছিনতাইকারী হয়ে উঠবে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা রেলওয়ে থানায় গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের দিকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে লোকজন এলে তাদের কাছে ১৫ জনকে হস্তান্তর করেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিব-উল-হোসেন।
সজীবের পরিবারের দাবি, সজীবের বয়স যখন সাত মাস, তখন তার মা কাজল মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর থেকে নানা-নানির কাছে টঙ্গীতেই বড় হতে থাকে সজীব। বাবা তানজিল বেঁচে থাকলেও সজীবের খোঁজ নেন না কখনো। সজীবের বাবার বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানায়।
১৫ শিশুকে যখন থানার ভেতরে আটকে রাখা হয়েছিল, তখন কাঁদতে দেখা যায় সজীবকে। কাঁদতে কাঁদতে সজীব এনটিভি অনলাইনকে বলে, ‘আমি ঘুরতেছিলাম স্টেশনে। আমাকে ধরে এনেছে। আমি বললাম, আমার নানার মোবাইল নম্বর আছে। কিন্তু কেউ কথা শোনে না। ছেড়ে দিলে আমি বাড়ি যাব।’
একই সময়ে সাগর নামের আরেক শিশু বলে, “আমি স্টেশনে ঘুমাচ্ছিলাম। পুলিশ গিয়ে আমাকে বলল, ‘স্যার কথা বলবে। তোমাকে যেতে বলেছে।’ তার পর থেকে পুলিশ আমাকে থানায় আটকে রেখেছে। এখন লোকজন এসে নিয়ে যাচ্ছে।”
সজীব ও সাগর যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সেখানে ওসি রাকিব-উল-হোসেন উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এরা তো এখন কাঁদবেই। কারণ, এদেরকে ছেড়ে দিলে একটু বাদেই হয় ভিক্ষা করবে, নতুবা নেশা করবে। এর চেয়ে ভালো ওরা একটা ভালো স্থানে থাকুক। ভালোভাবে মানুষ হোক।’
থানায় ভেতরে থাকা অবস্থায় এ প্রতিবেদক যখন শিশুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তারা কাঁদছিল আর বেরিয়ে যেতে চাইছিল। যাদের লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলো সাইফুল, আলামিন, রাহাত, নাঈম, সজীব, জনি, সাগর, মোহাম্মদ, হিরো, হৃদয়, রাব্বি, আকাশ, রনি, দুলাল ও রিসাত। এদের সবার বয়স ১২ বছরের কম।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে নজিরুল ইসলাম নামের একজন কিশোরদের নিতে থানায় এসেছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ তাদের ধরেছে। আমরা এসেছি থানায় এদের নিতে। এরা আমাদের ওখানে থাকবে। এর ভেতরে যদি তাদের পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে আমরা তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে দেব। আর তা না হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা আমাদের কাছে থাকবে।’
সজীবের দেওয়া নানার মুঠোফোন নম্বর অনুযায়ী যোগাযোগ করা হলে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি আর ওর নানি ছয় দিন ধরে টঙ্গীসহ কমলাপুর, তেজগাঁও ও বিমানবন্দর থানায় এলাকায় খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। খেলা করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি সজীব। এদিকে বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে ওর নানি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।’
রাকিব-উল-হোসেন বলেন, ‘এই কমলাপুরে এখন আগের চেয়ে অপরাধ কমে এসেছে। সমস্যা আছে মূলত শিশুদের নেশায় জড়িয়ে পড়া আর ভিক্ষা করা। তাই আমরা এদেরকে ওই সংস্থার কাছে হস্তান্তর করছি। এতে করে তাদের জীবনমান উন্নত হবে। বাস্তবতা সম্পর্কেও বুঝতে পারবে তারা। আমরা চাই, স্টেশনে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় না থেকে তারাও ভালো জীবনযাপন করুক। আর তা না হলে পরে এরা ছিনতাইসহ ভয়ংকর সব অপরাধ করবে।’