জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ মানবে না

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের মিথ্যাচার জনগণ বিশ্বাস করবে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ বুধবার বিকেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘ইতিহাস কথা কয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল এই মন্তব্য করেন। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
মির্জা ফখরুল বলেন, “সত্য কথাটা উঠে আসুক এজন্য যে, আজকে আমরা ‘ইতিহাস কথা কয়’ বলে এই অনুষ্ঠান করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ একটি তাবেদার রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের সরকার একটা পুতুল সরকার। তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই, জনগণবিচ্ছিন্ন একটি সরকার। সেই কারণে তারা মিথ্যা দিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।”
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মিথ্যা কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি তিনি পরবর্তীকালে যখন দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি চিরভাস্কর হয়ে আছেন।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রতিহিংসায় এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠার বহুমুখী প্রচারণা চালাচ্ছে। আজকে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। আর এই যে আক্রমণ, এই আক্রমণের পাল্টাজবাব হিসেবে সত্য জানার অধিকার ও প্রকৃত ইতিহাস চর্চার সংস্কৃতিকে গোটা জাতির ভবিষ্যতৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমাদেরকে জীবন্ত রাখতে হবে।’
“সেই লক্ষ্যেই বিএনপি ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে লাগাতার সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘ইতিহাস কথা কয়’ এই শিরোনামে বিএনপি সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে সম্পৃক্ত করতে চায়। যতদিন বিকৃতির তৎপরতা চলবে, ততদিনই এই লড়াই চলবে। যখন ইতিহাসের ঘটনাকে তারা দলীয় বয়ানে প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হবে তখনই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হবে ‘ইতিহাস কথা কয়’। এই লড়াই চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
মির্জা ফখরুল প্রশ্ন তুলেন, “আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রায়কেও অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কারণ ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অপরাধমূলক ঘটনা। কিন্তু অপরাধমূলক ঘটনার বিচারকাজ; উক্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে এজাহার দায়ের করে, তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে, সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী-সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিচারকাজ সম্পন্ন করেছে। ওই বিচার প্রক্রিয়ার পর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজ চ্যাপ্টারকে’ পুনরায় বির্তকের বিষয় হিসেবে তুলে এনে আইনমন্ত্রী জ্ঞানপাপীর পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁর এই ধরনের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন জাগে, ওই বিচারপ্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগের ভাষায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার পর এই ধরনের বক্তব্য কেন দিচ্ছেন? এই ধরনের বক্তব্য কি ক্রিমিনাল এক্সিকিউশনের পর্যায়ে পড়ে না?”
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরলে আওয়ামী লীগ ভয় পায়। বাংলাদেশের মৌলিক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়ন, দেশকে স্বনির্ভর করা, দেশকে সম্মানজনক অবস্থানে নেওয়া, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য দেশকে প্রস্তুত করা এসব কারা করেছে? সবগুলোতেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সফলতা রয়েছে। সেজন্যই তারা সত্য ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য, এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইতিহাসকে বিকৃতি করছে।’
সাবেক এই মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট এলে নিজেদের তৈরি কথা জনগণকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে। সেখানেই আমাদের প্রতিবাদ, সেখানেই আমাদের সত্য কথা বলার প্রয়োজনীয়তা। সত্য যদি প্রকাশিত হয় তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অস্তিত্ব থাকে না। সেজন্য আজকে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে তারা চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগকে বলব, সময় বেশি নাই, একদিন আপনাদেরকেই ইতিহাস বিকৃতির জন্য জনগণের কাছে জবাব দিতে হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের মহান বীরত্বের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তারা দেশবাসীকে বুঝাতে চায় যে, একটা ভাষণ দিয়েছে তাদের নেতা, এতেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এই যে লাখো মানুষ জীবন দিল, একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে নিল এই কৃতিত্ব কাউকে দিতে চায় না তারা। স্বাধীনতার ঘোষণা তো একজন রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকেই আমরা আশা করেছিলাম। তিনি বা তারা দিতে পারেননি। দিয়েছেন একজন অখ্যাত মেজর জিয়াউর রহমান। এই হীনমন্যতা থেকে তারা ইতিহাস বিকৃত করছে সেই ১৯৭২ সাল থেকেই।’
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘সর্বশেষে তারা শুরু করেছে যে, জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তারা ভেবেছে যে, ৫০ বছরের কাছাকাছি গত হয়েছে। সুতরাং, এখন এই ধরনের মিথ্যাকে সত্য করার সময় এসে গেছে। মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে গোয়েবেলসীয় কায়দায় জিয়াকে হত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে জনগণের সামনে প্রতিপাদ করার জন্যে তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সময়ে সেনাবাহিনীর ৪৬তম বিগ্রেডের কর্মরত হাফিজ উদ্দিন দাবি করেন, “ওই ঘটনার দিন ভোরে বিগ্রেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়েত জামিলসহ আমি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে দেখা করি। তাঁকে কর্নেল সাফায়েত জামিল বললেন, ‘স্যার, প্রেসিডেন্ট হেড বিন কিল্ড’। জেনারেল জিয়াউর রহমানের রিঅ্যাকশন দেখেন, সাচ এ সোলজার। তিনি বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট নাই তো কী হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে। আমরা সৈনিক, লেট আস আপহোল্ড দ্যা কনস্টিটিউশন, আমরা সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখব। গো অ্যান্ড গেট ইউ ট্রুপস রেডি’।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘তিন বছর আগে সাফায়েত জামিল মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি একটি বই লিখেছেন সেখানে এই ঘটনাটির বিবরণ দেওয়া আছে। অবসরপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্নেল সাফায়েত জামিল কোনো রাজনীতিতে জড়াননি কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি দুবর্লতা ছিল। তারপরও তিনি ১৫ আগস্ট সকালের সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যের এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আমার বইতেও এই বিবরণ আছে। আমরা চাক্ষুষ সাক্ষী, সেদিন তিনি (জিয়া) কী বলেছিলেন।’
মেজর হাফিজ বলেন, ‘জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক ছিলেন, যিনি সংবিধান সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদেরকে বলেছিলেন, গো অ্যান্ড গেট ট্রুপস রেডি। তাদের নেতাকে (শেখ মুজিবুর রহমান) মহান নেতা বলে সম্বোধন করেছিলেন। জীবনে কোনোদিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কখনো আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের যারা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো কটূক্তি করেননি। এই ধরনের একজন সাদা মনের মানুষকে আজকে তারা খুনি হিসেবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে চায়। কী দুর্ভাগ্য তাদের, কী দুর্ভাগ্য আমাদের!’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি বলব, এখনও সময় আছে শিক্ষা নেওয়ার। আফগানিস্তানে কী হয়েছে- এটা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেককে কিন্তু হেলিকপ্টারের ডানা ধরে ঝুলতে হবে! আফগানিস্তান থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারছি যে, জনগণের জয় একদিন না একদিন হবেই? দেশের অধিকাংশ জনগণ যাকে সমর্থন করবে, যে দল বা যে আদর্শকে সমর্থন করবে সেটিকে কোনোদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। যার জন্য পৃথিবী সবচেয়ে সর্বশক্তিমান পরাশক্তিকেও আফগানিস্তান থেকে যেতে হয়েছে।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্পর্কে এই ক্ষমতাসীন দলটি প্রথম থেকেই হীনমন্যতায় ভোগে এবং তাঁর অবদানকে কোনোভাবে তারা সহ্য করতে পারে না। প্রায় ৪৯ বছর পর স্মৃতিচারণ করে বুঝতে পারি, সেই আমল থেকে রাজনৈতিক সরকার শহীদ জিয়াকে উপযুক্ত মূল্যায়ন না করে অপদস্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু শহীদ জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশে পুনর্গঠনে অবদান রাখার স্বার্থে চাকরি অব্যাহত রাখেন।’
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘যাদের বয়স কম তাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশ ফোর্সকে তিন খণ্ড করে আলাদা আলাদা সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী করা হয়েছিল। সেই সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন কর্নেল কাজী মো. শফিউল্লাহকে এবং উপ-সেনাপ্রধান করা হয়েছিলো জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু জ্যেষ্ঠতায় জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রাধিকার পাওয়া হকদার। এখন অনুমান করছি, কেন এই কাজটি করা হয়েছিল। কারণ জিয়াউর রহমানের ক্যারিশমাকে তারা ভয় পেতেন, আজও ভয় পাচ্ছেন। যার জন্যে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁর নামে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি বলব, অপপ্রচার থেকে বিরত থাকুন, অযথা দেশে বিভাজন সৃষ্টি করবেন না।’
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সঞ্চালনায় সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু প্রমুখ বক্তব্য দেন।