চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড : ঢাকার আরেকটি কালোরাত
রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগের রাতটি ঢাকার জন্য কালোরাত হয়ে গেল। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় একটি ভবনে লাগা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সরু গলিতে। পুরান ঢাকা ঘিঞ্জি গলিতে ওই সময় ছিল যানজট, দোকানগুলোও ছিল খোলা।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টার হাজি ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। আজ বৃহস্পতিবার ওই ঘটনার প্রথম বার্ষিকী পালিত হবে।
রাত পোহালেই ঢাকার মানুষের প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়ার কথা, রওনা দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। অথচ নির্ঘুম রাত কাটে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই এলাকায়। মানুষের কান্না-আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে ঢাকার আকাশ। শুরুতে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ৬৭ জনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এরমধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
রাত প্রায় সাড়ে ১০টার দিকে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। চুড়িহাট্টার নন্দকুমার পাঁচমুখী মোড়ে তখনো তীব্র যানজট। ঘিঞ্জি রাস্তায় আটকে ছিল প্রাইভেটকার, পিকআপ, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন। ঠিক ওই সময়ই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকাটি।
ঘটনার পর ১৩টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এতে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। সরু গলি হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের বেশ বেগ পেতে হয়।
ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় ছিল কেমিক্যালের গুদাম ও প্লাস্টিকের তৈজসপত্র তৈরির উপকরণের চারটি দোকান। আগুন দ্রুত ভবনটির পাশের আনাস হোটেল, রাজ হোটেলসহ উল্টো পাশের চারটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে একটি কমিউনিটি সেন্টারও ছিল। ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের জায়গাগুলো থেকে উদ্ধার করা হয় মরদেহ। দুর্ঘটনায় ভবনের সামনে থাকা দুটি প্রাইভেটকার, দুটি পিকআপভ্যান, ছয়টি মোটরসাইকেল ও ৩০টি রিকশা পুড়ে যায় বলে তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছিল।
নিহতদের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও ছিলেন পথচারী, দোকানের মালিক-শ্রমিক, রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক, রেস্তোরাঁয় থাকা মানুষ।
ওয়াহেদ ম্যানশনের কাছেই মোবাইল ফোন কেনাবেচার দোকান ছিল মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু নামে দুই ভাইয়ের। আগুন দেখে দোকানের শাটার লাগিয়ে ভেতরে থেকে যান দুই ভাই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিয়ের মাত্র ২৪ দিনের মাথায় ওই অগ্নিকাণ্ডে মারা যান রাজু। তাঁর স্মৃতির কোলে গত নভেম্বর মাসে এসেছে শিশু আফরাজ। বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।
ফেব্রুয়ারি মাসটা বাঙালির কাটে বিভিন্ন উৎসবেও। শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তাবাসসুম দোলা। বৃষ্টি পড়তেন গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজে আর দোলা পড়তেন ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। শৈশব থেকে দুই বান্ধবী এক সাথে চলতেন। চুড়িহাট্টার ওই অগ্নিকাণ্ডের সময় দুজনই ছিলেন রিকশায়। একইসঙ্গে প্রাণ যায় দুই বান্ধবীর। ঘটনার পর ৭ মার্চ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বৃষ্টির এবং ১২ মার্চ দোলার মরদেহ শনাক্ত করা হয়।