চিরনিদ্রায় দ্বীনি শিক্ষার বাতিঘর আল্লামা শফী
দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাসের অন্যতম এক নাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর সমমানের মর্যাদা আদায়ে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের নেতা। ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি আর আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে যেকোনো বিষোদগারে আল্লামা শফী ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। নিভৃতে দীর্ঘ সময় ধরে দ্বীনি শিক্ষার এক বাতিঘর ছিলেন আলেমদের এই মহান আলেম।
দেশের লাখ লাখ মানুষের দোয়া, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে চিরদিনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে চলে গেলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা আহমদ শফী। আজ শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামসহ দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ এই জানাজায় অংশ নিয়ে তাঁদের বড় হুজুরের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। পরে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই তাঁকে দাফন করা হয়।
আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জানাজায় ইমামতি করেন তাঁর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী। মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ হয়ে আশপাশে এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
এ বিষয়ে মাওলানা ইউসুফ মাদানী দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাবার জানাজায় লাখো মানুষ উপস্থিত হয়েছে। দুপুর সোয়া ২টায় জানাজা শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে দাফন সমন্ন করা হয়।’
এর আগে আজ ফজরের নামাজের পর থেকেই হাজার হাজার আলেম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে জড়ো হন। কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীসহ আশপাশের জেলাগুলোর বহু কওমি মাদ্রাসা থেকে বিপুল শিক্ষার্থী ও আলেম জানাজায় অংশ নিতে আসেন।
রাজধানী ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আজ সকাল ৯টার দিকে আল্লামা শফীর মরদেহ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পৌঁছায়।
এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন শাহ আহমদ শফী। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ।
আহমদ শফী বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতা ছাড়াও ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনে ভুগছিলেন। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে হেফাজতে ইসলামের আমিরকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার বিকেলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আহমদ শফীকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনা হয়। তাঁকে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠের পাশে অবস্থিত আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে শূরা কমিটির সভায় মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও শূরা সভার প্রধান হিসেবে তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল।
আল্লামা আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মরহুম বরকত আলী ও মায়ের নাম মরহুমা মেহেরুন্নেছা।
আহমদ শফী ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির নির্বাচিত হন। তিনি ইসলামী শিক্ষালাভের জন্য ১০ বছর বয়সে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯৪১ সালে চলে যান ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সেখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ-এর প্রেসিডেন্ট আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানীর কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ এবং তাঁর খেলাফতপ্রাপ্ত হন।
ভারত থেকে দেশে ফিরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৮৬ সালে এই মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব নেন আহমদ শফী। এর পর থেকে টানা ৩৪ বছর তিনি ওই পদে ছিলেন। ২০০৮ সালে আল্লামা আহমদ শফী কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
আল্লামা আহমদ শফি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর লেখা ‘হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’, ‘ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা’, ‘ইসলাম ও রাজনীতি’, ‘হাদিসসমূহের ব্যাখ্যা’সহ ২২টি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন, দেশ-বিদেশে ৫০ লাখের বেশি মুরিদ ও ভক্ত রয়েছে আল্লামা আহমদ শফীর।