করোনাযোদ্ধা একজন মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা এবং প্রতিরোধে এগিয়ে আসছেন মানবতাবাদী অনেকেই। আমাদের দেশেও এ ধরনের অসংখ্য মানুষ মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এ শ্রেণির মানুষরা সাধারণত নিজেকে নিয়ে নয়, অন্যকে নিয়েই ভাবতে বেশি ভালোবাসেন। এরা মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে পিছু হটেন না কখনো।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের স্বাস্থ্য পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক তাদেরই মধ্যে একজন। গত ৮ মার্চ থেকে সারা দেশে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ঠিক তার আগে থেকেই এই স্বাস্থ্য পরিদর্শক মাঠপর্যায় থেকে সর্বত্র নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি প্রায় সব কর্মকাণ্ডে। দিন-রাত তিনি ব্যস্ত আছেন কোভিট-১৯ এর রোগী সম্পর্কিত সব কর্মকাণ্ডে। জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের যেকোনো জায়গায় তাঁকে স্মরণ করামাত্র তিনি হাজির হন।
মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক মানিকগঞ্জ সদরের পৌর এলাকার ৩২৫, বান্দুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা। বাবা মোসলেম উদ্দিন আহম্মেদ ও মা মৃত আমেনা বেগমের নয় সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান মোস্তাক। মোস্তাক ১৯৭১ এর ৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সাংসারিক জীবনে তাঁর এক ছেলে ও সহধর্মিণী রয়েছেন। মোস্তাকের সহধর্মিণীও স্বাস্থ্য বিভাগে কর্তব্যরত আছেন।
‘গত ৮ মার্চের আগে থেকেই দেশে প্রবাসীদের জন্য যখন হোম কোয়ারেন্টিনের সরকারি আদেশ জারি করা হয় মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক ঠিক তখন থেকেই জেলার কোয়ারেন্টিনে থাকা সবার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তাঁকে সার্বক্ষণিকভাবে আমরা এই বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখছি। কোভিট-১৯ এর এমন কোনো সেক্টর নাই যেখানে মোস্তাকের অংশগ্রহণ নাই।’- কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আখন্দ। সিভিল সার্জন আরো বলেন, ‘মোস্তাকের মতো এমন ভালো মানুষ আমাদের খুবই দরকার। যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা, আবার কেউ যদি করোনার উপসর্গও নিয়ে মারা যান তাঁর সৎকারের কাজেও তাঁর অংশগ্রহণ আমরা দেখতে পেয়েছি। আসলে ওর কাজের প্রশংসা করলে ওকে ছোট করা হবে। কেননা আমি মনে করি, মোস্তাক একজন করোনাযোদ্ধার মূর্তরূপ। আমি তাঁর সেবার দীর্ঘপথ সুন্দর হোক এই প্রত্যাশা করি।’
এদিকে, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক সম্পর্কে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘মোস্তাক প্রকৃতপক্ষে অন্য সবার চেয়ে কাজের দায়িত্বে একটু বেশি আন্তরিক। অনেকেই করোনা সংকটে কাজ করে যাচ্ছে তবে তাঁর মতো এতোটা বেশি কাজ কমই করছেন। তাঁর মতো এমন মানবতাবাদী সুন্দর মনের মানুষ দেশের এই ক্রান্তিকালে সত্যি খুব বেশি প্রয়োজন।’
অপরদিকে, জেলায় প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী বলেন, ‘মোস্তাক ভাই প্রথম থেকেই আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন। একজন রোগীর নিয়মিত খোঁজ নিলে কিন্তু রোগীর ভালো লাগে। কয়জন এমন খোজ নেন? এই দুঃসময়ে একমাত্র মোস্তাক ভাইই আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন।’
এদিকে, করোনায় আক্রান্ত পুলিশ দম্পতি বলেন, ‘নিয়মিত তদারকি ও খোঁজ-খবরের ভিত্তিতেই তাঁরা সুস্থ হয়েছেন। আর এই তদারকির কাজটা করে এসেছেন মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক ভাই।’ তাঁরা বলেন, মোস্তাক ভায়ের নির্দেশনায় মালটা, লেবু, গরমপানি ইত্যাদি নির্দেশনা অনুযায়ী চলার ফলে মাত্র ১৪ দিনেই তাদের দ্বিতীয় ধাপের করোনার টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
মোস্তাক তাঁর দিনের সিংহভাগ সময়টাই ব্যয় করছেন কোভিট-১৯ এর সংক্রমিত রোগীদের দেখভালের মধ্য দিয়ে। তার এই মহৎ কাজের জন্য প্রতিবেশীরাও গর্বিত।
মোস্তাক সম্পর্কে প্রতিবেশী কাজী আলমগীর বলেন, ‘একজন নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে আমরা সত্যি খুবই গর্বিত। এই ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই কাজ করে না। মোস্তাকের স্থানে হয়তো আমি হলেও এমনটা করতাম না। প্রায় প্রতিদিনই দেখি, মোস্তাক ভাই অতি আন্তরিকতার সঙ্গে কোভিট-১৯ এর জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।’
এদিকে মোস্তাকের সহধর্মিণী সুচরিতা বিশ্বাস করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মোস্তাক যে কাজ করে যাচ্ছে তাঁর জন্য তাঁকে বাধা নয় বরং উৎসাহ ও সব সময়ই সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
অপরদিকে মোস্তাক বলেন, ‘আমি একাত্তরে জন্ম নিয়েছি কিন্তু যুদ্ধ পাইনি। দেশ বিজয়ের সময় আমার বয়স মাত্র ১০ দিন। বড় হয়ে যুদ্ধের কথা শুনেছি আর ভেবেছি আমিও যদি যোদ্ধা হতে পারতাম। আমার মনে হয় আমরা এখন নতুন এক যুদ্ধে পা রেখেছি। আর সেটা হলো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। করোনা মোকাবিলাকে আমি আমার জীবনে যুদ্ধ হিসেবে বেছে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি মানবসেবার চেয়ে বড় কোনোকিছু থাকতে পারে না। এই মহামারির সময় মানুষের পাশে থেকে যদি আমিও আক্রান্ত হয়ে মারা যাই তবে আমার দুঃখ থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘ আমার সহকর্মীরা আমাকে এই কাজে সার্বক্ষণিক উৎসাহ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সিভিল সার্জন আনোয়ারুল আমিন আখন্দ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান আমাকে এই কাজে সব সময় সাহায্য ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন আমার স্ত্রী।’
স্ত্রীর প্রসঙ্গে মোস্তাক বলেন, ‘আমার স্ত্রীও একজন স্বাস্থ্যসেবায় কর্তব্যরত কর্মী। সে সবসময় আমার এই কাজে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার বিষয়ে খেয়াল রাখেন এবং করোনার এই সময় বাঁধা নয় বরং যোদ্ধা হিসেবেই বাইরে যেতে উৎসাহ দেন।’