আতঙ্কের নাম ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’, মিলেছে নাইজেরীয়ও
দেশে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ের পেছনে যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট সক্রিয় ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এই নাজুক অবস্থার মধ্যে দেশে মিলেছে নাইজেরীয় ভ্যারিয়েন্ট। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ভারতীয় ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট। যা প্রতিবেশী দেশটিকে বিপর্যস্ত করে ফেলছে। দেশটি করোনায় সংক্রমণ ও মৃতের তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে উঠে আসার পেছনে এই ভ্যারিয়েন্টই সক্রিয় রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এখানেই ঘটছে বিপত্তি। পাশের দেশের এই পরিসংখ্যান দেখে আতঙ্কিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ।
ভারতের এই পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত দেশের বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা বলছেন, ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস দেশে ঢুকলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে ভয়াবহ। বিপর্যয় নেমে আসতে পারে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। পাশের দেশ ভারতের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই ভ্যারিয়েন্টকে মোকাবিলা করা ‘বিরাট চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে দেখছে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। সেজন্য কমিটি সম্প্রতি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল, যেন ভারতের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ আপাতত বন্ধ রাখা হয়। আজ থেকে ১৪ দিনের জন্য ভারতের সঙ্গে সব স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে থেকে বিমান যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে ভারতের সঙ্গে।
‘কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা উচিত’
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে সতর্কতা উচ্চারণ করে জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করেও এর থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। ফলে মেনে চলতে হবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি। আর তা না হলে বড় বিপর্যয় আসতে পারে দেশে। ভেঙে পড়তে পারে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য ভাইরাসের চেয়ে তিনগুণ বেশি বলে শুনেছি। ফলে অনেক সতর্ক হওয়া দরকার আমাদের। একইসঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থারও উচিত, মানুষ যাতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য হয় তা নিশ্চিত করা। কঠিন হলেও এটাই করা উচিত সরকারের।’
একই সুরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ভারতের পরিস্থিতি সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার মতো। আপনি যতই সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, এর ভেতরে যদি কেউ ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে দেশে প্রবেশ করেন; তাঁর মাধ্যমে কিন্তু এটা ছড়াতে পারে। এবং পাশের দেশের ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু কোনো না কোনোভাবে দেশে প্রবেশ করবে। এটা ঠেকানো মুশকিল। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় দেখি না। কিন্তু রাস্তার পরিস্থিতি দেখে ভয় লাগে। সরকার যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, মানুষ তো ঠিকই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বাইরে ঘোরাফেরা করছে।’
দেশে মিলেছে নাইজেরীয় ভ্যারিয়েন্ট
আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘দেশে এরই মধ্যে পাওয়া যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের পর এবার নতুন করে পাওয়া গেছে নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। এ পর্যন্ত আট থেকে ১০ জনের শরীরে নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা খুবই নগন্য। তবে আরও বেশি লোকের শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করেছে কি না তা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে একজনের শরীরেও পাওয়া যায়নি। তবে আমরা সতর্কতা হিসেবে দেখার চেষ্টা করছি, ভ্যারিয়েন্টটি প্রবেশ করেছে কি না। সেজন্য নমুনা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
‘প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মালে ভাইরাস ধরন বদলায়’
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, ভাইরাসটি নানা সময়ে তার ধরন বদলেছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সুলতানা শাহনা বানু বলেন, ‘মানুষের শরীরে যখন করোনার বিরুদ্ধে অল্পবিস্তর প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়, তখন ভাইরাসটি তার ধরন পরিবর্তন করে ফেলে। যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়িয়ে তারা নতুন করে বংশবিস্তর করতে মরিয়ে হয়ে ওঠে, যাকে বলে মিউটেশন। ভাইরাস ধরন বদলালে ভাইরাসটি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। এটাই নিয়ম।’
ভারতের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ
ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্টটি এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পাওয়া গেছে। ফলে দেশে এই নতুন ধরনটি নিয়ে উদ্বেগের অনেক কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলী বলেন, ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটা যদি বাংলাদেশে কোনোভাবে ঢুকে পড়ে, তাহলে তা দেশের মানুষের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে; বিষয়টি কিন্তু লক্ষ্য করার দরকার। পশ্চিমবঙ্গ সেজন্য আমাদের জন্য খুব ইন্টাররেন্টিং একটি জায়গা। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে বাঙালির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অনেকখানি মিল থাকবে। সুতরাং খুব ঘনিষ্ঠভাবে আমাদেরকে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
‘নন-মেডিকেল লকডাউন’
বাংলাদেশে গত পাঁচ এপ্রিল থেকে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। যা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘লকডাউন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। পরে ১২ ও ১৩ এপ্রিল বাদ রেখে সরকার পুনরায় কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেন। যা আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান থাকবে।
এ বিষয়ে টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই যে লকডাউন চলছে, এটাকে আমি বলি নন-মেডিকেল লকডাউন। এই লকডাউনের মধ্যে কোনো মেডিকেল টার্ম নেই। আমরা সরকারকে এই জিনিসটি এখন পর্যন্ত বুঝাতে পারিনি। আমরা বারবার সরকারকে বলছি, এসব লকডাউন লকডাউন খেলা না করে নির্দিষ্ট স্থান ভাগ করে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হোক। যারা সংক্রমিত হবে, তাদেরকে আলাদা করে হোম অথবা প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করা হোক। আর সবাইকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা হোক। কিন্তু কে শোনে কার কথা?’
‘ভারতে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আক্রান্ত বেড়েছে ১৩০ ভাগ’
আজ রোববার ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটিতে একদিনে রেকর্ড সংখ্যক তিন লাখ ৪৯ হাজার ৬৯১ জনের করোনা ধরা পড়ে। এদিন সারা দেশে মারা গেছে দুই হাজার ৭৬৭ জন। ১৫ এপ্রিলের পর থেকে দেশটিতে প্রতিদিন দুই লাখেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলো রোগীতে উপচে পড়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক হাসপাতাল রোগী ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সেখানে মৃতদের দাহ করার জন্য চিতা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। কবর দিতে গিয়েও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে কোথাও একদিনে এত রোগী আর শনাক্ত হয়নি। নতুন শনাক্তদের নিয়ে ভারতে মোট কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা এক কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দেশটিতে করোনায় মৃতের মোট সংখ্যা এক লাখ ৯২ হাজার ৩১১ জনে দাঁড়িয়েছে। গত দুই সপ্তাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় ১৩০ ভাগ। মোট সংক্রমণের হিসেবে মৃত্যুর হার এক দশমিক ১৩ শতাংশ।
‘পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের হার বেড়েছে ২৫৩ শতাংশ’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিন দিক থেকে স্থলসীমান্ত রয়েছে। এ ছাড়া জলপথেও ভারতের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলাচল হয় স্থলপথে; পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতোই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গেও। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনও চলছে। করোনার কারণে শেষ দুই দফায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো দলীয় সমাবেশ-সভা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ১৪ হাজার ২৮১ জন। আর এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের। গত দুই সপ্তাহের তুলনায় এ রাজ্যে আক্রান্তের হার বেড়েছে ২৫৩ শতাংশ। আর এখানে সংক্রমণের হিসেবে মৃত্যুর গড় হার এক দশমিক ৪৯ ভাগ।
রেকর্ড আক্রান্ত ও মৃত্যু বাংলাদেশে
এদিকে বাংলাদেশেও করোনার বাড়বাড়ন্ত চলছে। করোনা শুরুর পর থেকে এখন সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১১ হাজার ৫৩ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া দেশে নতুন করে আরও দুই হাজার ৯২২ জন আক্রান্ত হয়েছে।