অদম্য স্বেচ্ছাসেবী কোভিডযোদ্ধা শারমিন আক্তার জুঁই
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে আজ অবধি আইসোলেশন সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে রোগী ও মৃতদের স্যাম্পল সংগ্রহ, পরীক্ষা এবং ভর্তিকৃত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন ভৈরবের শারমিন আক্তার জুঁই।
নিজেরসহ তিন শিশু সন্তান, স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি জেনেও জুঁই প্রতিদিন তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মানবসেবার এমন বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বর্তমানে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি।
যখন প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছিল শত শত! লকডাউনে অচল সব কিছু! চারদিকে আতংক! মানুষকে ঘরে রাখতে এবং নতুন এই মহামারি থেকে রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন সম্মুখযোদ্ধা প্রশাসনের লোকজন; আর আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা ও পরীক্ষায় প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। তখন সম্মুখযোদ্ধারাই আক্রান্ত হতে লাগলেন। এতে সংকট আরও তীব্রতর হতে লাগল।
সেই সময় ভৈরবের ২০ শয্যার বিশেষায়িত ট্রমা সেন্টারকে কোভিড-১৯-এর আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন সেখানে আক্রান্তদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু লোকবল সংকটে সেখানকার চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হতে লাগল। কারণ এখানে দায়িত্বরতরা একে একে আক্রান্ত হয়ে নিজেরাই কোয়ারেন্টিনে যাওয়া শুরু করলেন।
তখন চারিদিকের পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নিল যে, নিকটাত্মীয় আক্রান্ত হলেও কেউ কাউকে দেখতে পর্যন্ত যায় না, সেবা তো বহু দূরের বিষয়। ফলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কেউ কোভিডের স্যাম্পল সংগ্রহ, পরীক্ষা করা এবং আইসোলেশনে থাকা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবেন, এমনটি তো কেউ কল্পনাও করেন না।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে নির্ভীক শারমিন আক্তার জুঁই কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি-সদস্য সচিব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনা বেতনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এমন একজন কর্মী খুব প্রয়োজন থাকলেও, তিনটি শিশু কন্যার মা শারমিন আক্তার জুঁইকে তারা এই কাজে আসতে বারণ করেন। কিন্তু জুঁইয়ের অদম্য মনোবলের কাছে হেরে তাকে আইসোলেশন সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেন তারা।
জুঁই জানান, ২০১৬ সালে তিনি চিকিৎসা প্রযুক্তি বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ভৈরবের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি নেন। ২০১৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে যখন সারা দেশের মতো ভৈরবের করোনা পরিস্থিতিও খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যায়, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোভিড-১৯ আইসোলেশন সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে মানবসেবার এই সুযোগ গ্রহণ করবেন। বিষয়টি তিনি তার স্বামী স্কুলশিক্ষক আমিনুল ইসলাম লিটনকে জানান। স্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান স্বামী লিটন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের অন্য সদস্যরা।
বিশেষ করে মা ও শাশুড়িসহ অভিভাবক শ্রেণির আত্মীয়রা। তারা তার তিন শিশু সন্তানের বিষয়টি ভাবনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু স্বামীর সমর্থন আর নিজের ইচ্ছেশক্তিতে ভর করে সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং আইসোলেশন সেন্টারে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। জুঁইয়ের জন্ম ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের কালিকাপ্রসাদ গ্রামে।
জুঁই আরও জানান, প্রতিদিন তিনি সকাল থেকে রাত অবধি বিরামহীন স্যাম্পল সংগ্রহ, পরীক্ষার জন্য পাঠানো, তালিকা তৈরি করা, তথ্য সংরক্ষণ করা এবং ভর্তিরোগীদের সেবা করে গেছেন এবং এখনও করছেন। প্রথম প্রথম মৃতরোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহের সময় কিছুটা আতংকিত হলেও, পরে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
জুঁইয়ের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরটি হেল্পসেন্টারে দেওয়া ছিল বলে রাতদিন তার কাছে রোগী ও তাদের স্বজনদের কল আসে। সেই সব কল তাকে রিসিভ করতে হয়। উত্তর দিতে হয় নানা প্রশ্নের। শুধু আইসোলেশন সেন্টারে বসে নমুনা সংগ্রহ নয়, অনেক সময় কল পেয়ে আক্রান্ত রোগী এবং মৃতদের বাড়িতেও তাকে ছুটে যেতে হয়। শুধু শহর এলাকা নয়, উপজেলার এমন কোনো গ্রাম নেই, তাকে যেখানে যেতে হয় না।
এক প্রশ্নের উত্তরে জুঁই বলেন, কোভিডের প্রবল ঢেউয়ের সময় তাকে স্বামী-সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকতে হয়েছে। একই ঘরে থেকেও তিনি তার শিশু সন্তানদের বুকে জড়িয়ে আদর করতে পারেননি। তখন কিছুটা কষ্ট লাগত। কিন্তু মানবসেবার বিষয়টি ভেবে তিনি তার এই আবেগকে পরিত্যাগ করেছেন।
শারমিন আক্তার জুঁইয়ের স্বামী স্কুলশিক্ষক আমিনুল ইসলাম লিটন জানান, স্ত্রীর মানবসেবার মনোবাসনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং চাকরি ছাড়িয়ে সেখানে বিনা বেতনে কাজ করার অনুমতি দেন।
তখন তার স্কুল বন্ধ থাকায় সন্তানদের দেখাশোনা ও সেবায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি বাসায় থেকে সন্তানদের লালন-পালন করেছেন। আত্মীয়রা বাধা দিলেও তিনি তার স্ত্রীকে প্রেরণা দিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণাতেই করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দিনরাত কাজ করতে পেরেছেন। এখনও করে যাচ্ছেন নিয়মিত।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খুরশীদ আলম জানান, কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ পরিস্থিতির সময় শারমিন আক্তার জুঁই নামের এই স্বেচ্ছাসেবী মানবসেবায় এগিয়ে আসেন এবং আইসোলেশন সেন্টারে স্যাম্পল সংগ্রহসহ অন্যান্য কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছেন। আমরা তাকে আর্থিকভাবে কোনো সহায়তাই করতে পারছি না। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে অক্লান্তভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।