‘সরকার যখন হলি-ডে নির্ধারণ করল তখন পদক্ষেপ নেননি কেন?’
সরস্বতী পূজার কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটের দিন পরিবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো.খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এতে আগামী ৩০ জানুয়ারি দুই সিটিতে নির্বাচন হতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তবে হাইেকার্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন রিটকারি আইনজীবীরা।
আদালত আদেশে বলেন, ‘সামনে এসএসসি পরীক্ষা,তাই নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই।’ আদালত আরো বলেন, ‘সরকার আগে ২৯ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার জন্য সরকারি ছুটির দিন নির্ধারণ করেছেন। তখন রিট পিটিশনারসহ কেউ আপত্তি করেননি।’
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল নুর-উস সাদিক।
আদালতে অশোক কুমার বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত ভোট কেন্দ্র স্কুল-কলেজে হয়। আর সরস্বতীপূজাও হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এ কারণে একই দিনে ভোট ও পূজা হলে সাধারণ মানুষের পূজা উদযাপন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা সংবিধানেরও বিরোধী।’ তিনি আদালতে জানান,সরস্বতীপূজার তিথি ২৯ জানুয়ারি ৯টা ১০ মিনিট থেকে ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা পর্যন্ত।
তিনি বলেন, ‘পূজা-পার্বণ বাঙালীদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসবে সকল ধর্মের লোকজন অংশগ্রহণ করে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন পূজার দিন নির্বাচন ঘোষণা করে আমাদের অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখছে। এ কারণে উচ্চ আদালতের স্বরনাপন্ন হয়েছি। এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘দেখি এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী বলে? এ মুহূর্তে নির্বাচন পেছালে কী সমস্যা?’
এর জবাবে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী তৌহিদুল হক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সরকারি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন পেছালে আগামী তিন মাসেও নির্বাচন দিতে পারবে না। এসএসসি পরীক্ষা এরপর এইচএসসি পরীক্ষা রয়েছে।’
আদালত জানতে চান শুক্রবার ৩১ বা ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করা যায় কিনা?
জবাবে আইনজীবী তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন নির্বাচন করার নজির নেই। তাছাড়া নির্বাচন পেছালে বহু রকম জটিলতা তৈরি হবে। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। নির্বাচন কমিশন এ মুহূর্তে আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই মেনে নিব। আমরা মনে করি যেহেতু সরকারি ক্যালেন্ডারে পূজা ২৯ তারিখের কথা রয়েছে। তাই যদি ৩০ তারিখের সকাল বেলাও যদি পূজা থাকে তাহলে সকালে সামান্য কিছু সময়ের জন্য মাত্র। সেটা তারা পূজার কাজ একটু দ্রুত শেষ করলেও পারেন। এছাড়া একজন রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে উচিৎ ধর্মীয় কাজ সংক্ষিপ্ত করে রাষ্ট্রের কাজে সহায়তা করা। আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আহবান জানাবো রিটকারি যেন ত্যাগের মনোভাব নিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করেন।’
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক আদালতে বলেন, ‘গত বছর ডিসেম্বরে ২ তারিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির যে ক্যালেন্ডার আছে, সেখানে সরস্বতীপূজার ছুটি ২৯ জানুয়ারি বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ক্যালেন্ডারেও একই কথা বলা হয়েছে। ছুটির তালিকা দেখেই ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন আর ভোটের তারিখ পেছানোর সুযোগ নেই। কেননা,২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। হিন্দু ধর্ম সাধারণত পূজার দিন নির্ধারণ করেন বাংলা মাস দেখে। বাংলা বর্ষের পঞ্জীকা অনুযায়ী আমাদের দেশে পুজার দিন নির্ধারন করা হয় ১৫ই মাঘ। অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি। সরকারি ক্যালেন্ডারেও সেভাবে উল্লেখ করা আছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন পেছালে নির্বাচন ৩ মাস পিছিয়ে যাবে। বিভিন্ন রকমের জটিলতা তৈরি হবে। ’
এরপর বাংলাদেশে হিন্দু খ্রীস্টান বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত আদালতে বলেন, ‘এদেশে ১২ শতাংশ সংখ্যালঘু বসবাস করে। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। আমার সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন যদি পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ বহাল রাখে তাহলে রাষ্ট্রের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা দেখার অনুরোধ করছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হয় লগ্নও তিথি দেখে। এখানে তিথি হলো ২৯ তারিখ সকাল ৯টা ২৫ মিনিট থেকে ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা পর্যন্ত। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ দেখে তিথি নির্ধারন করেন। এবারের তিথি ৩০ জানুয়ারি সকাল ১১টা পর্যন্ত।’
এ সময় আদালত আইনজীবী রানা দাশগুপ্তর কাছে জানতে চান, ‘আপনারা তো বাংলা মাস দেখে উৎসব পার্বণ নির্ধারণ করেন?’
জবাবে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘পূজা সরকারি হলি-ডের ওপর নির্ভর করে না। বরং এসব প্রযোজ্য হয় বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে।’
পরে আদালত রানা দাশগুপ্তকে বলেন, ‘আপনি হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। এত বড় একটি সংগঠনের নেতা হয়ে সরকার যখন গত বছর ২ ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারে হলি-ডে নির্ধারণ করল তখন আপনারা এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলেন না কেন?’
জবাবে আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা তখন বিষয়টি খেয়াল করিনি।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘যদি নির্বাচন ৩০ তারিখ না হতো তাহলে ওইদিনতো স্কুল কলেজ খোলা ছিল। ক্লাশ চললে আপনি কীভাবে পূজা পালন করবেন?’
জবাবে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘কেন করতে পারব না। প্রতিষ্ঠান খোলার দিন ছাত্র-ছাত্রীরাই এতে অংশ নেয়।’
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমরা আদেশ দিচ্ছি।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনী কার্যক্রম এখন যে অবস্থায় আছে,ভোটের তারিখ পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই নির্বাচন পেছাতে যে রিট করা হয়েছে,তা সরাসরি খারিজ করা হলো।’
আদালত আদেশে বলেন,‘সামনে এসএসসি পরীক্ষা,তাই নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই।’ আদালত আরো বলেন, ‘সরকার আগে ২৯ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার জন্য সরকারি ছুটির দিন নির্ধারণ করেছেন। তখন রিট পিটিশনারসহ কেউ আপত্তি করেননি।’
এর আগে গতকাল সোমবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন পরিবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ।
গত ৫ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার কারণে ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণের নির্ধারিত তারিখ পেছানোর জন্য রিট করেন আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ।
আইনজীবী বলেন,২৯ ও ৩০ জানুয়ারি হিন্দু সম্প্রদায়ের সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হবে। কিন্তু ঢাকায় সিটি নির্বাচন উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এ জন্য সিটি নির্বাচনের পেছানোর জন্য রিটটি করা হয়েছে।