ভিডিও করে শিশুকে পিটিয়ে হত্যা

Looks like you've blocked notifications!
সিলেটে খুঁটির সাথে বেঁধে পেটানো হয় শিশু শেখ সামিউল আলম রাজনকে। ছবি : সংগৃহীত
 

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিশুটিকে (১৩) খুঁটির সাথে বেঁধে ক্রমাগত পেটান তিন যুবক। হাত-পাসহ শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে বারবার লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। আর এই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করেন তাঁদেরই একজন। শিশুটির শেষ আকুতি ছিল, ‘আমারে পানি খাওয়াও!’ তখন তার চোখ-মুখ বেয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছিল। এই আর্তনাদেও মন গলেনি। শিশুটিকে তাঁরা বলেন, ‘পানির বদলা ঘাম খা!’ কিন্তু ঘাম খেতে হয়নি। ততক্ষণে মৃত্যু হয় শিশুটির। 

গত বুধবার সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নির্মম এ ঘটনা ঘটে। আর গতকাল শনিবার রাত থেকে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। urgentPhoto

নিহত শিশুর নাম শেখ সামিউল আলম রাজন। তার বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় মাইক্রোবাসচালক। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করত। সবজি বিক্রির টাকা দিয়েই চলতো রাজনের পরিবারের খরচ।

রাজনের লাশ গুমের সময় হাতেনাতে মুহিত আলম (২২) নামের একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় লোকজন। মুহিতসহ চারজনকে আসামি করে জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা করেছেন রাজনের বাবা। মামলার অন্য আসামিরা হলেন মুহিতের বড় ভাই সৌদি আরব প্রবাসী কামরুল ইসলাম (২৪), তাঁদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫)। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চুরির অভিযোগ এনে গত বুধবার সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শিশু রাজনের ওপর নির্যাতন চালান কামরুল ইসলাম, আলী হায়দার ও ময়না। তাঁদের নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করেন মুহিত। তিনিই প্রথম ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন। 

ভিডিওতে দেখা যায়, নৈশপাহারায় ব্যবহৃত গোলাকার লম্বা লাঠি দিয়ে রাজনের হাত-পায়ের নখ ও পেটে আঘাত করছে। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। একপর্যায়ে কাতর হয়ে শিশুটি ক্ষীণ গলায় আর্তনাদ করতে থাকে ‘আমি মরি যাইয়ার! কেউ আমারে বাঁচাও রে বা!’ মারপিটের একপর্যায়ে কয়েক মিনিটের জন্য রাজনের হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। 

‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো...’ বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। ততক্ষণে নির্মম আঘাতে রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ ফুলে গেছে !

নির্যাতনের দৃশ্য যিনি ভিডিও ধারণ করছিলেন, তাঁকে একপর্যায়ে নির্যাতনকারীদের একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি না।’ ভিডিও ধারণকারী উত্তর দেন, ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব।’ 

শেষ দিকে রাজন যখন লুটিয়ে পড়ে তখন নির্যাতনকারীদের একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চান, ‘কিতা করতাম?’ অপর নির্যাতনকারী বলেন, ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’

পরে রাজনের লাশ গুম করার চেষ্টাকালে মুহিতকে আটক করেন স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ এসে রাজনের লাশ উদ্ধার করে এবং মুহিতকে আটক করে। 

রাজনের মা লুবনা আক্তার জানান, বুধবার রাতে ছেলে বাড়ি না ফেরায় তাঁরা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একপর্যায়ে তাঁরা তাঁদের সন্তানের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। 

লুবনা জানান, স্বামী আজিজুর যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসারের খরচ চালাতে রাজন সবজি বিক্রি করতে বের হয়। বুধবার রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ওই দিন ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য বের হয় রাজন। 

লুবনা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমার পুয়া (ছেলে) চোর না। ই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। (কামরুল) সৌদি আরব থেকে ফিরা অখলতের চোর ধরার সখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে আমার পুয়া! আমি ফাঁসি চাই। উচিত বিচার চাই।' 

জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত বুধবার এ ঘটনার পর অভিযুক্তরা রাজনের লাশ গুম করার চেষ্টা করে। ওই দিনই পুলিশ লাশসহ মুহিতকে আটক করে। তবে ওই ঘটনা সাধারণ চোর পেটানোর ঘটনা হিসেবেই চাপা পড়ে যায়। মুহিতের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও জব্দ করা হয়েছে। 

রাজন হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন

শিশু রাজন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে সিলেট সদর উপজেলার কুমারগাঁও এলাকাবাসী। আজ রোববার সকালে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের পাশে মানববন্ধন করে এলাকাবাসী। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ কর্মসূচিরও আয়োজন করে তারা। এ ছাড়া গতকাল শনিবার সকালে বাইয়ারপাড়া গ্রামবাসী জালালাবাদ থানার সামনে বিক্ষোভ করে। এর আগে তেমুখী পয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে জালালাবাদ থানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা অবিলম্বে রাজনের খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে ফাঁসির দাবি জানান।