রাউধার কক্ষের ফ্যান ও হোস্টেলের সিসিটিভির ফুটেজ জব্দ
যে ফ্যানে ঝুলে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী মালদ্বীপের মডেল রাউধা আতিফ আত্মহত্যা করেছেন বলে বলা হচ্ছে, সে ফ্যানটি পরীক্ষার জন্য খুলে নিয়ে গেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পাশাপাশি কলেজের মহিলা হোস্টেলের সিসিটিভির ফুটেজও জব্দ করেছে তারা।
বৃহস্পতিবার সকালে সিআইডির একটি দল নগরীর নওদাপাড়ায় ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে তদন্ত করতে যায়। এ সময় রাউধার কক্ষের ফ্যান ও সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করে তারা। সিআইডি কর্মকর্তারা এ দিন হোস্টেলের অন্য ছাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা হোস্টেল ত্যাগ করেন।
এদিকে, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে রাউধার মৃতদেহ বৃহস্পতিবার তোলার কথা থাকলেও তা হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আসমাউল হক জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে রাউধার লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তের জন্য এবারও মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে কিন্তু বোর্ড গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিজ্ঞ চিকিৎসক রাজশাহীতে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে লাশ উত্তোলনে বিলম্ব হচ্ছে। তবে দুই-তিনদিনের মধ্যে রাউধার লাশ তোলা হতে পারে বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল তদন্ত শেষে সিআইডির রাজশাহী বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ‘বলা হচ্ছে রাউধা তাঁর কক্ষের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন, তাই আমরা ফ্যানটি পরীক্ষা করে দেখব। এ জন্য ফ্যানটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
নাজমুল করিম খান বলেন, ‘ফ্যানে যদি ৫০ থেকে ৫৫ কেজির কিছু ঝোলে, তবে সেখানে একটি চাপ পড়বে। যারা চাপ মাপেন, আমরা তাদের কাছে ফ্যানটি নিয়ে যাব। তারা পরীক্ষা করে দেখবেন ফ্যানটিতে আদৌ এই চাপ পড়েছে কী না। ফ্যানে কিছু ঝুললে কিছু দাগও থাকবে। পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা সেই বিষয়গুলো নিশ্চিত হতে চাই।’
এখন পর্যন্ত রাউধাকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি জানিয়ে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তাঁকে হত্যার বিষয়টি আমরা এখনো কোনোভাবে নিশ্চিত হতে পারিনি। নিশ্চিত হলে বলতাম। চিকিৎসক বলছেন আত্মহত্যা, বাবা বলছেন হত্যা। চিকিৎসকের মতো আমরা সরাসরি আত্মহত্যা বলছি না। ঘটনা যাই হোক, আমরা নিশ্চিত হয়েই বলব।’
সিআইডির ২০-২৫ জনের ওই দলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আসমাউল হকও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ফ্যানের পাশাপাশি আমরা ছাত্রী হোস্টেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও জব্দ করেছি। ঘটনার আগে ও পরের সিসিটিভির ফুটেজ আছে। কিন্তু ঘটনার দিনের কেন নেই? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। ফুটেজের হার্ডডিস্কটিই নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা এটিও পরীক্ষা করব। এতে জানা যাবে, ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে, নাকি রেকর্ড হয়নি।’
সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের ছাত্রী হোস্টেলের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাউধা আতিফের বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফ। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘রাউধার ঘরের দরজা আটকে সিআইডি কর্মকর্তারা বার বার সজোরে ধাক্কা দিয়ে সেটি খোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দরজা খোলেনি, ভেঙেও যায়নি। তাহলে ঘটনার দিন কীভাবে খুলল? এটা একটা বড় প্রশ্ন।’
মোহাম্মদ আতিফ বলেন, ‘সিআইডি কর্মকর্তারা হোস্টেলের ছাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কেউ দেখেনি রাউধা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। মালদ্বীপের ছাত্রীরা সিআইডিকে বলেছে, লাশ বিছানায় ছিল। পুলিশ আসার আগে কেন লাশ নামানো হলো? এটাও একটা বড় প্রশ্ন। পরীক্ষার আগের রাতে রাউধাকে জুসের সঙ্গে কেন ট্যাবলেট মিশিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছিল? কেউ তাঁকে আগে থেকেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।’
প্রসঙ্গত, গত ২৯ মার্চ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হোস্টেল থেকে রাউধার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাউধা এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নীলনয়না রাউধা ছিলেন মালদ্বীপের একজন উঠতি মডেল। মাত্র ২১ বছর বয়সী রাউধার ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
রাউধার লাশ উদ্ধারের দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানিয়েছে, রাউধা তাঁর কক্ষের ভেতর থেকে দরজা আটকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। শিক্ষার্থীরা দরজা ভেঙে তাঁর ঝুলন্ত লাশ নামিয়েছে। এ ঘটনায় ওই দিনই কলেজ কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে নগরীর শাহ মখদুম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) মর্গে রাউধার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।
ময়নাতদন্তকারী মেডিকেল বোর্ডের তিন সদস্যের দুজন ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। তাঁদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাউধা আত্মহত্যা করেছেন। তবে এই প্রতিবেদন মানতে নারাজ রাউধার বাবা। গত ১০ এপ্রিল রাউধার বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফ রাজশাহীর আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন।
রাউধা হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রাউধাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ মামলায় রাউধার সহপাঠী সিরাত পারভীন মাহমুদকে (২১) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। সিরাতের বাড়ি ভারতের কাশ্মীরে।
সিরাতের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সিরাতকে দেশ ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ মামলার তদন্তকাজ চলা অবস্থায় তিনি দেশ ত্যাগ করলে তদন্তে সমস্যা হবে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে না বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নির্দেশ অমান্য করে সিরাত যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ইমিগ্রেশনগুলোতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
রাউধার মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে তাঁর কক্ষ থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সেগুলো সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সে প্রতিবেদন এখনো ঢাকা থেকে আসেনি। এরই মধ্যে গত ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলা দুটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে সিআইডির পরিদর্শক আসমাউল হক রাউধার লাশের পুনরায় ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেন। এ জন্য গত ১৬ এপ্রিল তিনি আদালতে আবেদন করেন। ১৮ এপ্রিল আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। লাশ তোলার সময় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. রক্তিম চৌধুরী উপস্থিত থাকবেন।