আইন ফাঁকি দিতে তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়েছেন সালমান!
‘২০০৭ সালে টাডা কোর্টের রায়ে সঞ্জয় দত্ত যখন জেলে যান, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা কিছু কম ছিল না। তুমুল জনপ্রিয়তার পরও জেলে যেতে হয়েছিল বিহারের প্রবাদপ্রতিম নেতা লালুপ্রসাদ যাদব ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা জয়রামকেও। কিন্তু তাঁরা কেউ যা পারেননি, তা পেরেছেন সালমান খান। ২০০২ সালে মুম্বাইয়ের ‘হিট অ্যান্ড রান’ মামলায় ওই ঘটনার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন এটা বোধহয় ‘তারকা’ সালমান খান নিজেও বিশ্বাস করবেন না।’ -এভাবেই সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল আলোচিত বলিউড সুপারস্টার সালমান খানের মামলার ব্যাপারে তেহেলকা ডট কমের কাছে নিজের মতামত জানান বোম্বে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আভা সিং। সালমানের আলোচিত মামলার আবেদনকারী ছিলেন তিনিই।
নিম্ন আদালতে যে মামলার নিষ্পত্তি হতে পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর, ১০ মিনিটের মধ্যে সেই রায়ের ওপর অন্তর্বর্তী জামিন জোগাড় হওয়াটা বিস্ময়জাগানিয়া ঘটনা তো বটেই। গত শুক্রবার যেভাবে তাড়াহুড়া করে নতুন জামিন ও আপিল মামলার আবেদন গ্রাহ্য হয়ে গেল, তাতে সেই বিস্ময় বেড়েছে বৈ কমেনি। সরকারি আইনজীবীর তরফে মামলা সাজানোতেই গলদ থেকে গিয়েছিল কি না, উঠেছে সেই প্রশ্নও। এ অবস্থায় তেহেলকার কাছে মামলার বাদী আভা সিংয়ের অভিযোগ, আইন ফাঁকি দিতে তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়েছেন সালমান!
তেহেলকা ডট কমকে দেওয়া আভা সিংয়ের এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আলোচিত এ মামলার ভেতরের কিছু কথা।
প্রশ্ন : আপনি বলেছিলেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী কামাল খানকে বাদীপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে রেখেছে এবং মামলার এই ফাঁকটিই সালমানকে রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন।
আভা সিং : ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় এক বেকারির দেয়ালে ধাক্কা মারে সালমানের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার। মারা যান একজন। গাড়িতে তখন কতজন ছিলেন, কে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তা নিয়ে ধন্দ তৈরি করা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু সালমানের তৎকালীন দেহরক্ষী পুলিশ কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল ও গায়ক-অভিনেতা কামাল খান যে গাড়ির পেছনের আসনে ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো পক্ষেরই। যেহেতু রবীন্দ্র পাতিল বেঁচে নেই, সুতরাং কামাল খান যে এই জটিল এবং আলোচিত মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, এটা বলাই বাহুল্য।
২০০৮ সালে কামাল খান মামলাটির ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজিরা দিয়ে একটি বন্ডে স্বাক্ষর করেছিলেন, মামলার প্রয়োজনে তাঁকে যখন ডাকা হবে তখনই তিনি হাজির হবেন। মামলার এমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হওয়ার পরও সরকারিপক্ষের মামলা পরিচালনাকারী তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এরপর থেকে আর কামালের কোনো খোঁজ মেলেনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, কামাল খান এখন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী।
কামাল খানকে এরপর আদালতে সরকারপক্ষের সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়নি। এমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হওয়ার পরও তাঁকে কেন ছাড়া হলো এবং কেন তাঁকে আর ডাকা হয়নি, সেটাই এই মামলার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমি মনে করি, মামলাটিকে দুর্বল করতে এটা পুলিশের একটা চাল। এবং এই চালই শেষপর্যন্ত মামলার স্থগিতাদেশে ভূমিকা রেখেছে।
প্রশ্ন : আপনি বলতে চাইছেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ কোনোভাবে বিবাদীপক্ষকে সাহায্য করেছে? এবং এটাই সালমান খানকে অবৈধভাবে পার পেয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে?
আভা সিং : দেখুন, কামাল এই মামলার একজন অতিগুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। পুলিশের রেকর্ড বলছে, সালমানের সঙ্গে দুর্ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন কামাল। ঘটনার পর পুলিশ তাঁর জবানবন্দি নিয়েছিল। তাতে তিনি জানিয়েছিলেন, সালমানই চালকের আসনে ছিলেন। পেছনের আসনে ছিলেন তিনি আর দেহরক্ষী পাতিল। সালমান মদ্যপ অবস্থায় ভয়ানক জোরে গাড়ি ছোটাচ্ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি আদালতে এই বয়ান পাল্টে ফেলেন।
বয়ান পাল্টানো সাক্ষীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নিষেধ আছে। কামাল খানের হাজিরার ব্যাপারে ২০১৪ সালে একটি সমনও জারি করা হয়। তখন যদি পুলিশ এবং আদালত সাক্ষী হিসেবে তাঁকে মামলা থেকে বাদ না দিত, তাহলে প্রকৃত ঘটনাটি ঠিক বেরিয়ে আসত। একমাত্র অসৎ উদ্দেশ্যেই তাঁকে এই মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন : এই মামলায় সালমান খান একজন সেলিব্রিটি হওয়ার মূল্য দিচ্ছেন, এই কথাটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আভা সিং : সালমান খান একজন সেলিব্রিটি হওয়ার মূল্য দিচ্ছেন, এ কথাটি একেবারেই ভুল। অন্যভাবে বলা যায়, আইন ফাঁকি দিতে তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়েছেন সালমান! তিনি প্রায় ১০০ বার আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন যা অন্য কেউ পেয়েছে কি না সন্দেহ। আদালতের রায়ে পাঁচ বছরের সাজা হওয়ার তিন ঘন্টা পর মুক্ত মানুষ হিসেবে বের হয়ে গেছেন সালমান। তাঁর জন্য নজিরবিহীনভাবে আদালতের কার্যক্রম সন্ধ্যা সাতটা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চালানো হয়েছিল, যাতে তিনি জামিন পান। অন্যসব হিট এন্ড রান মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে মামলার নিস্পত্তি করতে হয় সেখানে এই মামলাটি ১৩ বছর পর্যন্ত ঝুলে ছিল। কারণ পুলিশ তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছে। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে, তিনি সেলিব্রিটি বলেই। সালমান তাঁর খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন, এবং লোকজনকে বোকা বানিয়েছেন। এখন তাঁর জনসংযোগ বিভাগ এটা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, সালমান খান একজন সেলিব্রিটি হওয়ার মূল্য দিচ্ছেন !