দেহরক্ষীর জীবন যেভাবে 'ধ্বংস' করেছেন সালমান খান
কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল ২০০২ সালে সালমান খানের দেহরক্ষী ছিলেন। ১৯৯৮ ব্যাচের এই সাহসী কর্মকর্তা মুম্বাই পুলিশে যোগ দেন, পরে বিশেষ অভিযান স্কোয়াডে (এসওএস) যোগ দিতে কমান্ডো প্রশিক্ষণ নেন। এসওএসের মূল দায়িত্ব ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেওয়া। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে সালমান খান হুমকি পাওয়ার মুম্বাই পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে পাতিলকে তাঁর নিরস্ত্র দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০০২ সালে সালমানের গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার (হিট-অ্যান্ড-রান) ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে সালমানের পাশে বসেছিলেন পাতিল। এই কর্মকর্তার বীরত্বের কাছে বলিউডের অ্যাকশন হিরোর জন্য মায়াকান্না তেমন কিছু নয়।
তেহেলকা ডটকম জানায়, বলিউডের শক্তিধর ব্যক্তিত্ব সালমান খানের বিরুদ্ধে যে জবানবন্দি তিনি দিয়েছিলেন, তা পরিবর্তনের জন্য তাঁর কাছে ব্যাপক চাপ এসেছিল। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কথা পরিবর্তন করেননি। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ঘটনার সময় সালমান খান মদ্যপ ছিলেন এবং তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
২০০৬ সালে পাতিলকে পুনরায় জেরা করতে সালমান মুম্বাইয়ের শীর্ষ আইনজীবী ভাড়া করেন। পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার দরুন রবীন্দ্র পাতিল জানতেন যে তাঁর ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে। পরে একদিন পাতিল নিখোঁজ হয়ে যান, তাঁর ভাই স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে নিখোঁজ রিপোর্ট দাখিল করেন।
পরপর পাঁচদিন আদালতে হাজির হতে না পারায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো। এমনকি তাঁর বিভাগও (পুলিশ) তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। পাতিলের কথা শোনার কেউ ছিল না এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে বরখাস্ত করা হলো।
সবচেয়ে কঠিন দৃশ্যের অবতারণা হয়: প্রত্যক্ষদর্শী পরিণত হন ভুক্তভোগীতে। মহাবলেশ্বরের একটি ছোট হোটেল থেকে পুলিশ পাতিলকে গ্রেপ্তার করে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের মধ্যে আর্থার রোডের কারাগারে পাঠায়। এই বেচারা পুলিশকে কারাগারে অনেক ভুগতে হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে তাঁকে নির্মম নির্যাতনও করা হয়।
কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তিনি এরই মধ্যে অনাহূত ব্যক্তিতে পরিণত হন। অন্য কথায়, নিজের পরিবারেও তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষে পরিণত হয়ে পড়েন।
এই পুলিশ সদস্যের জীবনের শেষ দিনগুলো অত্যন্ত করুণভাবে কাটে। মানবিক ও একজন কর্তব্যনিষ্ঠ অফিসার হওয়ার কারণে তাঁকে ভুগতে হয়। পাঁচ বছর পর মহারাষ্ট্রের এই সৎ পুলিশ কর্মকর্তাকে রাস্তায় ভিক্ষুকদের ভিড়ে পাওয়া যায়। দুই বছর ধরে যক্ষ্মা রোগে ভোগেন তিনি। ২০০৭ সালে তাঁকে সেউরি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, শেষ পর্যন্ত যক্ষ্মায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। এই কঠিন সময়ে পুলিশ, সংবাদমাধ্যম ও পরিবার সবাই তাঁকে ভুলে গিয়েছিল।
সেই রাতে কী হয়েছিল? (রবীন্দ্র পাতিলের জবানবন্দি অনুসারে)
পাতিল আদালতকে বলেন, ‘২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০২, রাত সাড়ে ৯টা। অভিযুক্ত (সালমান খান) ও কামাল খান তাঁদের বাসভবনের একটি কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাকে বলেন, তাঁরা জুহুর রেইন বারে যাবেন। অভিযুক্তের একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি ছিল, যার নিবন্ধন নম্বর এমএইচ ০১ ডিএ ৩২। অভিযুক্ত গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।’
‘তাঁরা আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন, অভিযুক্ত ও কামাল হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। সোহেল খানের দেহরক্ষীর সঙ্গেও আমার দেখা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর অভিযুক্ত ও কামাল বাইরে এলেন। অভিযুক্ত বসলেন চালকের আসনে, আমি ঠিক তাঁর পাশে বসলাম। কামাল বসেন পেছনের সিটে।’
রেইন বারের প্রত্যক্ষদর্শী
বারের পরিচারক মলয় বাউগ বলেন, অভিনেতার লোকজন পানীয় অর্ডার দেন। ব্যবস্থাপক রিজওয়ান রাখানগি বলেন, তিনি সালমান খানকে এক গ্লাস বর্ণহীন পানীয় হাতে দেখেন।
রেইন বার থেকে সালমান বেরোলেন
পাতিল বলেন, রাত সোয়া ২টায় সালমান খান রেইন বার থেকে বের হন এবং তাঁরা জেডব্লিউ ম্যারিয়টের দিকে যান, সেখানে তাঁকে আবারও অপেক্ষা করতে বলা হয়। এ সময় সালমানকে পাতিল সতর্ক করে গাড়ি ধীরে চালাতে বলেন। ঘণ্টায় ৯০-১০০ কিলোমিটার গতিতে চালাচ্ছিলেন সালমান।
‘সোয়া ২টায় বের হওয়ার পর অভিযুক্ত যখন চালকের আসনে বসলেন। আমি বললাম, তিনি গাড়ি চালাবেন কি না। তিনি আমাকে এড়িয়ে গেলেন। অভিযুক্ত ঘণ্টায় ৯০-১০০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হিল রোডের মোড়ে পৌঁছানোর আগে ডানে ঘোরার সময় আমি অভিযুক্তকে গাড়ি ধীরে চালাতে বলি। তিনি আমাকে আবারও এড়িয়ে যান। মোড় ঘোরার সময় অভিযুক্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, ফুটপাথে গাড়ি উঠে যায়,’ যোগ করেন পাতিল।
দুর্ঘটনাস্থল
কিছুক্ষণ পর গাড়িটি আমেরিকান এক্সপ্রেসের বেকারিতে আছড়ে পড়ে এবং এর শাটার ভেঙে ফেলে। আদালতকে পাতিল বলেন, ‘ব্যাপক চিৎকার শোনা গেল এবং লোকজন আমাদের পাশে জড়ো হলো। আমি তাদের আমার পরিচয়পত্র দেখালাম এবং বললাম আমি একজন পুলিশ, এতে তারা শান্ত হলো। অভিযুক্ত ও কামাল ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। আমি গাড়িটির কাছে গিয়ে দেখি একজন মারাত্মক আহত হয়েছেন। আরো চারজন গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আছেন।’
ঘটনার পর এবং গাড়ির নিচে ক্রন্দনরত আহত লোকজনকে ফেলে অভিযুক্ত সালমান খান ও কামাল পালিয়ে যাওয়ায় পাতিল নিজেই পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে সাহায্য চেয়ে ফোন দেন। বান্দ্রা পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
পাতিল বলেন, ‘গাড়িটি দ্রুতগতিতে চলায় এবং অভিযুক্ত মদ্যপ থাকায় মোড় ঘুরতে গিয়ে গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, এসব কারণেই দুর্ঘটনা হয়।’
‘শেষ পর্যন্ত আমি আমার জবানবন্দির পক্ষে ছিলাম, তবে আমার বিভাগ আমার পক্ষে দাঁড়ায়নি। আমার চাকরি ফেরত চাই, আমি বাঁচতে চাই। আমি একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই,’ এই ছিল পাতিলের জীবনের শেষ কথাগুলো। যে ব্যক্তি মানবিক, তার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন, এই কি মানবজীবনের মূল্য?
৬ মে, ২০১৫
২০০২ সালে আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার এই নির্মম ঘটনায় বলিউড সুপারস্টার সালমান খানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।