জন্মদিন
কে ফর ‘কশ্যপ’
এক সময় করন জোহরকে রীতিমতো গালাগাল দিয়েছেন নিজের ব্লগে। পরে সেই করণের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এমনই বন্ধুত্ব হলো যে ‘কফি উইথ করন’ অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলেন অনুরাগ, আর করন জোহর অভিনেতা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন অনুরাগ কশ্যপের ছবি ‘বোম্বে ভেলভেট’-এর মাধ্যমে।
অনুরাগ কশ্যপ এমনই। মাথা গরম, ক্ষ্যাপাটে, একগুয়ে, স্বার্থপর এবং মেধাবী। এ রকম না হলে বলিউডের ঝা চকচকে দুনিয়ায় নিজের মতো কাজ করে টিকে থাকা যায় না। অনুরাগের যে মাথা গরম সেটা তো করন জোহরের ঘটনার উদাহরণ দিয়েই বোঝা গেল।
জি টিভির হোস্ট কোমল নেহতার সঙ্গে এক টিভি সাক্ষাৎকারে এই ঘটনা নিয়ে অনুরাগ বলেছিলেন, ‘ওটা আমার দোষ ছিল। তখন আমরা প্রথম কয়েকটা ছবি সেন্সর আটকে দিল, মুক্তি দিতে পারলাম না। অন্য ছবিগুলো ব্যবসা করছিল না। প্রোডিউসাররা পয়সা দিচ্ছিল না। তাই হতাশ ছিলাম, মেজাজও খারাপ থাকত। আর সেই হতাশায় নিজের ব্লগে ঝাড়তাম। ব্লগিং তখন নতুন ছিল, তাই বুঝতে পারিনি যে ব্লগ সবাই পড়তে পারে। আমি ভেবেছিলাম এটা পার্সোনাল ডায়েরির মতো, শুধু আমিই দেখতে পাচ্ছি।’
বলিউডকে বিশ্বজুড়ে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অনুরাগ। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে বলিউড মানেই অনুরাগ আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা।
১৯৭২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের গোরখাপুরে জন্মেছিলেন অনুরাগ কশ্যপ। সে হিসেবে আজকে ৪৩ বছরে পড়লেন অনুরাগ। নিজের জন্মদিনের সেরা উপহার বলেছেন মেয়ে আলিয়ার অভিনন্দনকে। অনুরাগের প্রথম স্ত্রী আরতি বাজাজ। আরতি-অনুরাগের মেয়ে আলিয়া। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও বাবার সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে আলিয়ার। নিজের এবং আলিয়ার একটি ছবি টুইট করেছেন তিনি।
অনুরাগের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। কিন্তু ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের কারণে পরিচালক রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৮ সালে রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে অনুরাগের পরিচয় করিয়ে দেন অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ী।
ভার্মার জন্য সৌরভ শুক্লার সঙ্গে যৌথভাবে ‘সত্য’ ছবির স্ক্রিপ্ট এবং ডায়লগ লেখেন অনুরাগ। রামগোপাল ভার্মাকে এরপর থেকে সবসময়ই ‘অসৎ মানুষ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনুরাগ। ভার্মার ওপর নিজের রাগ প্রকাশ্যেই ঝেড়েছেন অনুরাগ। কিন্তু কি নিয়ে অনুরাগ এত ক্ষ্যাপা সেটা কখনো বলেননি।
অনুরাগ যে আর ১০টা পরিচালকের মতো নন, সেটা তাঁর সিনেমার বাজেট দেখলেই বোঝা যায়। দুই কোটি থেকে ১২০ কোটি বাজেটের ছবি বানিয়েছেন তিনি। বলিউডের আর কোনো পরিচালক এত কম বাজেট থেকে এত বেশি বাজেটের ছবি পরিচালনা করেননি।
‘ডেভ ডি’ ছবির কাজ করতে গিয়ে প্রেমে পড়েন অভিনেত্রী কালকি কোয়েচলিনের। প্রথম স্ত্রী আরতি বাজাজের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নিজের চেয়ে ১২ বছরের ছোট কালকিকে বিয়ে করেন তিনি। যদিও দ্বিতীয় বিয়েটাও টেকেনি। এখন অনুরাগ একাই আছেন, ভালোই আছেন।
১৯৯৮ সালে বলিউডে যাত্রা শুরু করলেও অনুরাগ প্রত্যাশিত সাফল্য পান ১১ বছর পর ২০০৯ সালে। সে বছর মুক্তি পায় ‘ডেভ ডি’। এই ছবির মাধ্যমেই আলোচনায় চলে আসেন অনুরাগ। কিন্তু এই ১১ বছর অনুরাগ টিকে থেকেছেন সিনেমার প্রতি নিজের একগুয়েমির কারণে।
অনুরাগ পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘পাঁচ’। ২০০৩ সালে নির্মিত এই ছবিটি সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে মুক্তি পায়নি। তারপরও অনুরাগ বলিউডের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। নিজস্বতা বজায় রেখে কাজ করেছেন। অন্যের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন আর নিজের ছবির জন্য প্রযোজক খুঁজেছেন।
২০০৭ সালে মুক্তি পায় তার তিনটি ছবি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘নো স্মোকিং’ এবং ‘রিটার্ন অব হনুমান’। একমাত্র ‘নো স্মোকিং’ ছবির কারণে কিছুটা আলোচনায় আসেন তিনি। সেই ছবিতে অভিনয় করেন জন আব্রাহাম ও আয়শা তাকিয়া। আলোচনায় এলেও ছবিটি ব্যবসা করতে পারেনি।
শুধু একগুয়ে স্বভাবের কারণে অনুরাগ তারপরও লেগে থাকেন পরিচালনায়। এই সময়টুকুতে সবসময় অনুরাগকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন বিশাল ভরদ্বাজ ও ইমতিয়াজ আলী। পরিচালনায় নিয়মিত হলেও কখনো স্ক্রিপ্টিং থেকে দূরে সরে যাননি অনুরাগ। অন্যের জন্য লিখেছেন সবসময়।
অনুরাগ নিজেই বলেছেন, ‘ছবির জন্য পরিচালককে স্বার্থপর হতে হয়।’ নো বাজেট ফিল্ম বা কম বাজেটের ছবির সঙ্গে বলিউডকে পরিচয় করিয়ে দেন অনুরাগ। বলিউডে ইনডিপেনডেন্ট ছবি নির্মাণে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন অনুরাগ। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া অনুরাগের ‘গুলাল’ ছবিতে অভিনেতা বা পরিচালক কেউ প্রথমে পারিশ্রমিক নেননি। কথা ছিল ছবি যদি ব্যবসা করে তাহলে সবাই সেখান থেকে মুনাফার ভাগ পাবেন।
স্টার কাস্ট বা বিগ বাজেটের ছবি অনুরাগের ধাতে সয়না। তাই নিজের মতো করে ছবি বানানোর কৌশল বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। অনুরাগ তাঁর সময়ে বলিউডের সবচেয়ে মেধাবী নির্মাতা। এটা প্রমাণ করার জন্য তাঁর পরিচালিত ছবির নামগুলোই যথেষ্ঠ। ‘ডেভ ডি’, ‘দ্যট গার্ল ইন ইয়েলো বুটস’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘আগলি’, ‘বোম্বে ভেলভেট’।
এর মধ্যে দুই পর্বে মুক্তি পাওয়া পাঁচ ঘণ্টার ছবি ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর বাজেট ছিল ২০ কোটি রুপিরও কম। ‘দ্যাট গার্ল ইন ইয়েলো বুটস’ ছবির বাজেট ছিল দুই কোটি রুপির মতো। আর বোম্বে ভেলভেট ছবির বাজেট ছিল ১২০ কোটি রুপি!
অনুরাগের বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি তাঁর সন্তানদের সব সময় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন তিনি। নিজের বাবাকে বোঝাতে গিয়ে অনুরাগ বলেছেন, ‘বাবা সব সময় আমাদের একটা ভারতীয় প্রবাদ বলতেন। প্রবাদটা হলো, ‘ছেলের জন্য কিছু রেখে যাওয়ার কী দরকার। তোমার ছেলে যদি যোগ্য হয় তাহলে সে নিজেরটা নিজেই করে নিতে পারবে। আর সে যদি মানুষ না হয় তাহলে তুমি যে সম্পদ রেখে যাবে সেটাও সে বিক্রি করে দেবে।’
অনুরাগের পরিবারের সবাই হয় সরকারি চাকরি নয় শিক্ষকতা করেছেন। অনুরাগ পড়েছেন প্রাণিবিদ্যায়। সিনেমা বানানোর নেশায় চলে আসেন মুম্বাই। তারপর শুরু হয় তাঁর স্ট্রাগল। মুম্বাইয়ের রাস্তায় রাত কাটিয়েছেন আর ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখেছেন।
টিকে থাকার জন্য একসময় টিভির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। অনুরাগের বাবা সে সময় মুম্বাই এসে ছেলেকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো টিভির স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য মুম্বাই আসনি। তুমি এসেছিলে সিনেমা বানাতে। যেটা করতে এসেছ, সেটাই করো। শুধু শুধু আমাদেরকে লজ্জায় ফেল না।’ বাবার কথা শুনে ছেলে সিনেমা বানানোর কাজে হাত দেন।
নিজের মতো একগুয়ে, মেধাবী, স্বার্থপর ও ক্ষ্যাপাটে পরিচালকদের জায়গা করে দিতে ছবি প্রযোজনা শুরু করেন অনুরাগ। নিজের প্রতিষ্ঠান অনুরাগ কশ্যপ ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড এবং বন্ধুদের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছেন ফ্যান্টম।
অনুরাগের প্রযোজিত ছবিগুলো বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতেছে। ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারে যেসব ছেলেমেয়ে নিজের মতো করে ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখছেন তাঁদের সামনে একজনই আদর্শ রয়েছেন, অনুরাগ কশ্যপ।