বিশ্বনেতাদের প্রেম, বিয়ে
রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বিশ্বনেতা খেতাবধারী মানুষগুলোর কথা ভাবতেই মনে হয় কাজ আর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো একজন মানুষের কথা। চারপাশে যাঁদের শত টেলিভিশনের বুম, গণমাধ্যমের ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি। জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই মানুষগুলোর নিয়মানুবর্তিক জীবনে পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। এর মধ্যে আবার প্রেম-ভালোবাসা!
তবু প্রেম নামের এই আবেগটা নাকি কোনো কিছুরই বাঁধ মানে না। যখন কারো জীবনে আসে, জোয়ারে ছাপিয়ে যায়- ক্ষমতা, দায়িত্বের বেড়াজাল। এই বেড়াজাল ডিঙিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্র্রপ্রধান কেবল বাঁধভাঙা প্রেমের কারণে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন অসংখ্যবার। এর অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে কেলেঙ্কারিতে।
শুধু প্রেমের জন্যই যুগে যুগে রাষ্ট্রপ্রধানদের সিংহাসন ছাড়ার ঘটনাও আছে অনেক। এ জন্য ক্লিওপেট্রার মিসরে যেতে হবে না। এই বিংশ শতাব্দীতেই এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করার জন্য ব্রিটিশ রাজমুকুট ত্যাগ করে ইতিহাস লিখেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়েই কি আর স্ত্রীদের ভালো লাগে না ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানদের? নতুন প্রেম, বিয়ে ভাঙা আর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যেন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি থেকে বর্তমান ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট লৌহমানব পুতিন, সবাই লুটিয়ে পড়েছেন প্রেমের কাছে।
জেলে যাওয়ার আগে ইতালির বার্লুসকোনি তো ব্যয়বহুল বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন এক কিশোরীর প্রেমে পড়েই।
বারাক ওবামা
মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিবাহবহির্ভূত প্রেমের ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। উড্রো উইলসন থেকে জন এফ কেনেডি, অনেকের জীবনেই আছে এমন ঘটনা। ঐতিহ্য অনুযায়ী এমন ঘটনা থেকে বাদ পড়েননি বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
বিভিন্ন সময়ে ওবামা-মিশেলের সংসারের ভাঙনের খবর বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো। বিবাহবহির্ভূত প্রেমের কানাঘুষা ছিল আগে থেকেই। তবে ২০১২ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর এসব খবরের পালে যেন নতুন করে হাওয়া লাগে।
২০১২ সালের অক্টোবরে মার্কিন নির্বাচনের ঠিক আগে প্রভাবশালী মার্কিন ট্যাবলয়েড ‘দ্য সানডে টাইমস’ খবর প্রকাশ করে, ‘বিবাহবিচ্ছেদের ছুরি কেটে দিল ওবামা ও মিশেলের সংসার।’
তার কদিন পরেই এ আগুনে ঘি ছুড়ে ‘ন্যাশনাল ইনকোয়েরার’ নামের আরেক মার্কিন ট্যাবলয়েড। পত্রিকাটি জানায়, ওবামা-মিশেলের মধ্যে এসে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ বছর বয়সী ভেরা বেকার নামে এক মহিলা! নির্বাচনী প্রচারণা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত এ নারীর সঙ্গে ২০০৪ সাল থেকেই নাকি সখ্য গড়ে ওঠে বারাক ওবামার। এমনকি এ দুজনের হোটেলে রাতযাপনেরও প্রমাণ তাদের কাছে আছে বলে জানায় পত্রিকাটি।
এ গুঞ্জনে খোরাক জুগিয়েছে মিশেল ও বারাক ওবামার নানা কাণ্ডকীর্তি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, হোয়াইট হাউস নামে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাদা রঙের বাড়িটিতে এ বিবাহিত দম্পতি নাকি আলাদা বিছানা করে ঘুমান।
এরপর সম্প্রতি মিশেল নিজের ৫০তম জন্মদিনে নাকি স্বামীকে বাদ রেখেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কেক কেটে ফেলেছেন। এসব ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত বারাক ওবামাও নিজ মুখে প্রকাশ্যে নিজ বিবাহিত সম্পর্কের ওঠানামার কথা স্বীকার করেছেন!
ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ
একজন দক্ষ কূটনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি প্রেমিক হিসেবেও ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের খ্যাতি আছে। এমনকি প্রেমের কারণে দুবার বিবাহবিচ্ছেদও ঘটিয়েছেন তিনি।
২০০৭ সালের জুনে সাংবাদিক ভালেরির প্রেমে পড়ে ফ্রান্সের প্রভাবশালী নারী রাজনীতিক সেগোলেনে রয়ালের সঙ্গে প্রায় ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানেন ওলাঁদ। সম্পর্কোচ্ছেদের আগে ওলাঁদের চার সন্তান ছিল। ভালেরি পেশায় সাংবাদিক। তিন সন্তানের জননী।
এই প্রেমের গল্প পুরোনো হতে না হতেই জানা গেল ফরাসি অভিনেত্রী জুলি গেইটের সঙ্গে গোপনে দুই বছর ধরে প্রেম করেছেন প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ। এই খবর ফাঁস করে ফরাসি গসিপ ম্যাগাজিন ‘ক্লোসার’। ৪১ বছর বয়সী টিভি ও সিনেমা অভিনেত্রী জুলি গায়েতের সঙ্গে ৫৯ বছর বয়সী ওলাঁদের এ প্রেমকাহিনী পত্রিকাটি সাত পৃষ্ঠাজুড়ে নানা রঙিন ছবি দিয়ে প্রচার করে। এই ঘটনা প্রচারের পর ভালেরির সাথে তাঁর সংসার আর টেকেনি।
এ খবর প্রকাশের পর ফরাসি গণমাধ্যমে আলোড়ন তৈরি হলে ওই আলোচনা বন্ধ করার জন্য গণমাধ্যমগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন ওলাঁদ ।
নিকোলা সারকোজি
প্রেম বিষয়টি নিয়ে আরেক আলোচিত রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনিও কম বিতর্কের জন্ম দেননি।
১৯৮৪ সালে এক বিখ্যাত টিভি উপস্থাপকের সঙ্গে প্রথম বিয়ে হয়েছিল সারকোজির দ্বিতীয় স্ত্রী সিসিলিয়ার। বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, বিয়ের অনুষ্ঠানেই নাকি নববধূ সিসিলিয়ার প্রেমে পড়েন সারকোজি। সেই বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় সত্যি সত্যিই সারকোজির টানে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে সংসার আর দুই সন্তানকে ফেলে ঘর ছাড়েন সিসিলিয়া। তত দিনে অবশ্য সারকোজিও বিয়ে করে ফেলেছেন। কিন্তু তাতে কি? তিনিও প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে প্রেয়সীকে বিয়ে করলেন ১৯৯৭ সালে ।
কিন্তু এত ভাঙাগড়ার পরও সারকোজির জীবনে সিসিলিয়া এক সময় হয়ে যান ইতিহাস। ২০০৭ সালে ক্ষমতাসীন অবস্থায় বিবাহবিচ্ছেদে যাওয়া প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নাম লেখান সারকোজি। এরপর নানা ঘটনা-রটনার
অবসান ঘটিয়ে ২০০৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন ইতালিয়ান পপগায়িকা ও সুপার মডেল কার্লা ব্রুনিকে। অনেক টানাপড়েনের পর ব্রুনির সঙ্গেও তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বলে ফরাসি সংবাদমাধ্যমের খবর।
ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার লৌহমানব পুতিনকে এতদিন বিশ্ববাসী চিনত ইস্পাতকঠিন দৃঢ় এক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই। সেই পুতিনের নামের পাশে এখন লেগে গেছে প্রেমিক খেতাব। স্কাইনিউজের খবর অনুযায়ী, ২০১২ সালে ‘সামাজিক বিচ্ছেদ’ বলে নিজের ৩০ বছরের বিবাহিত স্ত্রী লুদমিলার সাথে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিলেও এর নেপথ্যে রয়েছে সাবেক জিমন্যাস্ট কাম মডেল বর্তমানে ইউনাইটেড রাশিয়া দলের আইন প্রণেতা ৩০ বছর বয়েসী সুন্দরী এলিনা কাবায়েভা।
ব্যক্তি জীবনে খেলাধুলা, শরীর গঠন আর শিকারের প্রতি অনুরাগী পুতিন প্রেমে পড়ে যান এই ব্যায়ামবিদ সুন্দরীর। দীর্ঘদিন ধরে তাদের রোমান্স চললেও তা উভয়েই অস্বীকার করে আসছেন।
উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ১২ মে ১৯৮৩ সালে তাজাখস্তানের তাসখন্দে জন্মগ্রহণ করেন এলিনা কাবায়েভা। ২০০৭ সালে রাজনীতিতে আসার আগে তিনি জিমন্যাস্ট হিসেবে অলিম্পিকে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন দুবার।
এ নিয়ে রাশিয়ার একটি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের পর পুতিন তা অস্বীকার করেছিলেন। পরে ওই পত্রিকা তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ডেইলি মেইল জানিয়েছে, এলিনা কাভায়েভাকে পুতিনের একটি ‘লাভ চাইল্ড’ জন্ম দিয়েছেন। যদিও তাঁরা উভয়েই তা অস্বীকার করেছেন।
সিলভিও বার্লুসকোনি
ইতালির তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি প্রেমের কারণে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন বহুবার। বর্তমানে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের দায়ে বর্তমানে সাত বছরের জেল খাটছেন।
১৯৭২ সালে প্রথম বিয়ে তাঁর। এরপর ১৯৮০ সালে মিলানের একটি নাট্যমঞ্চে অভিনয় করার সময় ভেরোনিকা লারিওর প্রেমে পড়েন ইতালির অন্যতম বিত্তশালী বার্লুসকোনি। সেদিনই সাজঘরে লারিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।
১৯৯০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। তাদের তিনটি সন্তান রয়েছে। ভেরোনিকা লারিও ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ঘরে বার্লুসকোনির একটি সন্তান রয়েছে।
অবশ্য এটিই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগে-পরে বার্লুসকোনির আরো কিছু প্রেমের গুজব ওঠে। এরপরও নিজের দল পিপল অফ ফ্রিডম পার্টির কাউন্সিলর ফ্রানসেসকা প্যাসকেলের সঙ্গে দীর্ঘদিন চুটিয়ে প্রেম করছেন তিনি।
সর্বশেষ যে ঘটনাটিতে তিনি আলোচিত হন তা, হচ্ছে ইতালির শীর্ষস্থানীয় মডেল ১৮ বছর বয়স্ক নোয়েমি লতিজিয়ার সঙ্গে প্রেমের কারণে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বার্লুসকোনি। নোয়েমিকে তার ১৮তম জন্মবার্ষিকীতে ৯৬ হাজার ইউরোর একটি নেকলেসও উপহার দেন বার্লুসকোনি।
আর এটিই হয় ভেরোনিকা লারির সঙ্গে তাঁর ঘরভাঙার কারণ। ২০১৩ সালে প্রতি মাসে ৩৬ মিলিয়ন ইউরো (৩০ মিলিয়ন ডলার) দেওয়ার শর্তে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন তিনি।
বিল ক্লিনটন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও আলোচিত প্রেম অথবা কেলেঙ্কারির ঘটনাটি না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এ গল্প। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার ৪২তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন সঙ্গে হোয়াইট হাউসের ইন্টার্ন ২২ বছর বয়সী মনিকা লিউইনস্কির প্রেমের খবর মিডিয়া আসলে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে তুমুল আলোচনা শুরু হয়।
১৯৯৫ সালে হোয়াইট হাউসে চাকরি পাওয়া মনিকার সাথে প্রেসিডেন্ট নিয়মিত অভিসারেও যেতেন বলে জানা যায়। ১৯৯৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ড্রাজ রিপোর্ট নামের এক ওয়েবসাইটে এ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়। এরপর এ বছরেরই ২১ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে বিশ্ববাসীকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের গোপন প্রণয়ের খবর পৌঁছে দেয়।