শ্রমিক ধর্মঘটে উত্তাল ভারত
সরকারের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপের প্রতিবাদে আজ বুধবার ভারতজুড়ে ধর্মঘট পালন করেছে ১০টিরও বেশি ট্রেড ইউনিয়ন। প্রায় ১৫ কোটি শ্রমিক এতে অংশ নেয়। তবে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাংক কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে।
ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থিত ভারতীয় মজদুর সংঘ (বিএমএস)। বিএমএস ও ন্যাশনাল ফ্রন্ট অব ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে যোগ দেয়নি। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত খাতের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকটি সংস্থা এই ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সরকার ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ধর্মঘট বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
কার্যত ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের শ্রম আইন সংশোধনী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এ ধর্মঘট। এ ছাড়া ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ নিয়েও রয়েছে জটিলতা। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি সারা দেশে বাধ্যতামূলকভাবে মাত্র এক হাজার রুপি বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই বৃদ্ধিকে ন্যূনতম তিন হাজার রুপি করার দাবি জানিয়েছে।
শ্রম আইনের সংশোধনী প্রস্তাব এবং ভূমি অধিগ্রহণ সংশোধনী অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করা; রেল-বিমা ও প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ও বেসরকারীকরণ বন্ধ; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসের তৎপরতা বন্ধ; গণবিপণন ব্যবস্থা বিস্তারের পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও স্বাস্থ্য বিমার পাশাপাশি বোনাস বাড়ানো, ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার এবং ন্যূনতম পেনশন তিন হাজার রুপি ঘোষণার দাবি।
গত জুলাই ও আগস্টে সরকার ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের এই দাবিগুলোর মধ্যে সাতটি দাবির ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে বলে সরকার জানিয়েছে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলো বলেছে, সরকার তাদের দাবিগুলো মেনে নেয়নি। বাস্তব কোনো সমাধান দেয়নি। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এআইটিইউসি) সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাসগুপ্ত বলেন, ‘কর আরোপের ব্যাপারে সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। সরকার কখনো বলেনি, আমাদের দাবি তারা মেনে নিয়েছে। ইউনিয়নগুলো চায়, সরকার এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক এবং আলোচনার জন্য এগিয়ে আসুক।’
ইউনিয়নের নেতারা জানান, ধর্মঘট জরুরি সেবা যেমন, ব্যাংক, পরিবহন এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেল সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলবে। তবে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তত্রেয়া আশা করছেন, এই ধর্মঘট জনজীবনের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না।
বিএমএস জানিয়েছে, সরকারি খাতের শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এই ধর্মঘটে যোগ দেয়নি। তাই জরুরি সেবায় তেমন প্রভাব ফেলবে না। বিএমএস এই ১২ দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু দাবি পূরণে সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে এই সংঘ। ইউনিয়নগুলো ও সরকারের মধ্যে আলোচনার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন বলে সংঘের নেতারা জানান। ধর্মঘট সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে। দত্তত্রেয়া বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আমরা সংঘাতে যেতে চাই না। শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থই আমাদের কাছে বড়।’
ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার খবরে বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের ধর্মঘটের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সরকারি কর্মীদের অফিসে আসার নির্দেশ জারি করে। ধর্মঘটে অংশ নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে একদিনের বেতন কাটা হবে — এমন হুমকিও দেওয়া হয়েছে। কলকাতা ও এর শহরতলিতে বিক্ষিপ্ত সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
কলকাতার ধর্মতলা, যাদবপুর, তারাতলা, বাঘাযতীন, করুণাময়ী, লেক টাউনসহ বিভিন্ন স্থানে বনধ সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু বাস, অটোরিকশা ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। কলকাতা শহরে পুলিশ প্রায় ৩০ জন বনধ সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। বনধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখানোর অভিযোগে শিলিগুড়ির মেয়র ও সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বনধ মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বনধ সমর্থকদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। বেশ কয়েকজন আহত হয়। বিভিন্ন স্থানে তৃণমূল কংগ্রেস বনধবিরোধী মিছিল বের করে। বনধে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা শহরের রাস্তা-ঘাট প্রায় জনমানব শূন্য ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল। ইস্টার্ন রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান,সকালে কয়েকটি জায়গায় অবরোধের কারণে শিয়ালদহের দক্ষিণ সেকশনে রেল চলাচল কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। বনধ মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাস্তায় বিপুল পুলিশ মোতায়েন করে।
ব্যাঙ্গালুরু শহরের মহিসুর রোডে বিক্ষোভকারীরা পাথর ছুঁড়ে প্রায় ১৫টি ভলভো ও ব্যাঙ্গালুরু মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিএমটিসি) বাস ভাঙচুর করেছে। এ কারণে এসব বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চেন্নাইয়ের মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (এমিটিসি) কর্মকর্তারা এই ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই ধর্মঘট স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তেমন প্রভাব ফেলেনি। রেল চলাচল অব্যাহত ছিল এবং স্কুলও চালু ছিল। সর্বভারতীয় ব্যাংক কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের (এআইবিইএ) সাধারণ সম্পাদক সি এইচ ভেঙ্কাটাচালাম বলেন, চেন্নাইয়ের কয়েকটি ব্যাংকের প্রায় ১৫ হাজার কর্মচারী ধর্মঘটে যোগ দেন।
দিল্লিতে অটোরিকশা ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে। তাই রাস্তাগুলোতে কম সংখ্যক অটোরিকশা ও ট্যাক্সি চলাচল করতে দেখা গেছে। কেরালার রাস্তায় সরকারি বাস চলাচল বন্ধ ছিল। দোকান ও ব্যাংকগুলো ছিল তালাবদ্ধ।
টেকনোপার্ক ও ইনফোপার্কে আইটি সংস্থাগুলোতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল বেশ কম।