‘নাকতলার জমিদার’ রাজ্জাকের শোকে বিহ্বল কলকাতার বাসিন্দারা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার সুপরিচিত গড়িয়া এলাকা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ নাকতলা। আর সেই নাকতলায় ছিল বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিত্রনায়ক নায়করাজ রাজ্জাকের পৈতৃক বসতভিটা। ছিল বিশাল সম্পত্তিও। রাজ্জাকদের পরিবার নাকতলার জমিদার পরিবার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
১৯৬৪ সালে নাকতলা ছাড়ার পরও নাড়ির টানে সেখানে বারবার গিয়েছিলেন রাজ্জাক। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়েও বারবার ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় নায়করাজের মৃত্যু খবর শুনতেই কলকাতার নাকতলা এলাকার মানুষ হয়ে পড়েছেন শোকবিহ্বল। কারণ, রাজ্জাককে তো তাঁরা তাঁদের ঘরের ছেলে বলেই মনে করেন আজও।
গড়িয়া ও নাকতলার পুরোনো বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই এলাকায় অনেক জমি জায়গা থাকার কারণে ওই এলাকায় এখনো রাজ্জাকদের পরিবারকে জমিদার পরিবার বলেই স্মরণ করেন তাঁরা। এই জমিদার পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজ্জাকও জমিদারের সম্মানই পেতেন। তবে এই নাকতলা এলাকায় আজ আর রাজ্জাকদের পরিবারের কেউই থাকেন না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের এক দাঙ্গার রাতে রাজ্জাকের পরিবার আতঙ্কে নাকতলার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। সে রাতে এলাকার এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরের দিন সকালে একরাশ দুঃখ নিয়ে ভারত ত্যাগ করেন তাঁরা। রাজ্জাক বাংলাদেশে গেলেও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বলে জানালেন স্থানীয়রা।
পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি নাকতলার বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ বাসিন্দা আজও ভুলতে পারেননি। তাইতো মঙ্গলবার সকালে এলাকায় ঢুঁ মারতেই বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখা গেল এলাকার বাসিন্দাদের।
নাকতলা এলাকায় রাজ্জাকের পরিবারের বিশাল সম্পত্তির ওপর এখন একটি বড় জনবসতি। উঠেছে ফ্ল্যাট বাড়িও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, আমাদের এখানে বেশিরভাগ বাড়িঘরই রাজ্জাকদের জমি জায়গার ওপরেই নির্মিত হয়েছে।
রাজ্জাকের বাল্যবন্ধু টি দাস ওরফে হিটলার জানালেন, এলাকার বাশদ্রোণীর কাছে খানপুর স্কুলে পড়াশুনা করতেন রাজ্জাক। যে স্কুলটি আজও রয়েছে। ছোট থেকেই রাজ্জাক অঙ্কে ছিলেন ভীষণ রকমের কাঁচা।
পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে হিটলার জানালেন, স্কুলের স্যারেরা রাজ্জাককে বলত অঙ্কটা অন্তত ভালো করে শেখ। যোগ বিয়োগ ঠিকঠাক করে না শিখলে পরিবারের এত সম্পত্তি সামলে রাখবি কি করে।
কলেজ জীবনে পড়াশুনার সময় থেকেই এক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়েন রাজ্জাক। পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েকেই বিয়ে করেন তিনি। স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে হিটলার জানালেন, যতোদুর মনে পড়ছে রাজ্জাকের সঙ্গে লক্ষ্মী নামে সেই হিন্দু মেয়েটির বিয়ে হয়।
রাজ্জাকের বিয়ের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি নাকতলা এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা। অনেকেই জানালেন, ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন রাজ্জাক। রীতিমতো গাড়ির বহর নিয়ে নাকতলার রোড দিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিল নায়করাজ। নায়কোচিত সাজে আর সাড়ম্বরেই বিয়ে হয়েছিল রাজ্জাকের। বিয়েতে এলাকার বাসিন্দাদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়েছিল প্রায় সপ্তাহ ধরে।
স্মৃতি রোমান্থন করতে করতে হিটলার জানালেন, ছোট বেলা পাড়ার নড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন রাজ্জাক।
হিটলারই জানান, ১৯৬৪ সালে ভারত ছেড়ে চলে গেলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে ফের নাকতলায় ফিরে আসেন রাজ্জাক। তারপর যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে যান ফের বাংলাদেশে। তবে তারপর থেকে জীবনে যতবার নায়করাজ কলকাতায় এসেছেন ততোবারই এই নড়ার চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেন। সময় কাটাতেন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। আজ সেই রাজ্জাক নেই ভেবে এলাকার অনেকেরই কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসতে দেখা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, উনি ছিলেন আমাদের প্রতিবেশীর মতোই। এখানে এসে তাঁর আচরনেও কোনওদিন মনে হয়নি তিনি বাংলাদেশের অতবড়ো একজন সুপারষ্টার।
রাজ্জাকের বন্ধু হিটলার জানালেন, ছোট বয়েস থেকেই নাটক ও অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিলো রাজ্জাকের। নাকতলা এলাকাতেই নিজে একটি নাটকের দলও গড়েছিলেন একসময়। এরপর মাত্র ১৮ বছর বয়েসেই অভিনয়ের জন্য মুম্বই পাড়ি দেন রাজ্জাক। তারপর টলিউডের অভিনয়ের জমি শক্ত করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্ত ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। ফলে বিফল হতে হয় বলিউড ও টলিউড থেকে। এরপর ভাগ্যের পরিহাসে ঢাকার ঢলিউডে গিয়ে তিনি সাফল্যের চূড়ায় ওঠেন।