হজ ও ওমরা
হজ কারা করবেন, ওমরা কারা করবেন?
সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন অবশ্যকর্তব্য। আমরা সব সময় চর্চা করি না বলে হজ পালন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা থাকে না। হজের শুদ্ধ পদ্ধতি, হজের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে জানা আমাদের কর্তব্য। এ লক্ষ্যেই এনটিভির বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হজ ও ওমরা’। এ অনুষ্ঠানে হজ ও ওমরাসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে দর্শক প্রশ্ন করেন। জয়নুল আবেদীন আজাদের উপস্থাপনায় এ অনুষ্ঠানে দর্শকের মনে জাগা এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন বিশিষ্ট আলেম ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ।
‘হজ ও ওমরা’র প্রথম পর্বের অনুলিখন করেছেন মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন।
আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্বের দ্বিতীয় কিস্তি
প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম। আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, বাসায় যদি মা-বাবা অসুস্থ অবস্থায় থাকে এবং বৃদ্ধ অবস্থায় তাঁদের খেদমত করার মতো কেউ না থাকে, এমতাবস্থায় আমার সামর্থ্য আছে আমি হজ করতে পারব কি না।
দ্বিতীয় : অনেক হিন্দু আছেন, তাঁরা আমাকে জানেন-চেনেন, তার পরও সালাম দেন। তাঁরা যে সালাম দেন, আমি এখন কীভাবে সালামের উত্তর দেব। আর আমার যাঁরা সম্মানীয় হিন্দু, তাঁদের আমি কীভাবে সম্বোধন করব?
উত্তর : মা-বাবা এমন পর্যায়ে অসুস্থ যে তাঁদের খেদমত করার কেউ নেই, আপনাকে এখানে থাকতেই হবে, আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি চলে গেলে তাঁদের খুবই প্রয়োজনীয় জিনিস পাবেন না। আপনি যদি হজে যান আর কেউ তাঁদের সহযোগিতা করতে পারবে না, যদি এমনটি হয় তাহলে আপনার ওপর ওয়াজিব হচ্ছে মা-বাবার খেদমত করা। সে ক্ষেত্রে আপনি হজের বিষয়টি দেরি করার জন্য চেষ্টা করবেন অথবা পরে আদায় করার চেষ্টা করবেন। তবে আপনি সেটার ব্যবস্থা করে যেমন কাউকে এর দায়িত্ব দিয়ে অল্প কয়েক দিনের জন্য হজ করতে যেতে পারেন, যেহেতু হজ আপনার ওপর ফরজ। তবে রাসূল (সা.)-এর হাদিস সহি বুখারি এবং মুসলিম থেকে বোঝা যাচ্ছে যে (হাক্কুল ওয়ালে দায়িন) মূলত হজের ওপর এর অধিকার বেশি। যেহেতু দুটোই ফরজ কাজ, তার মধ্যে (হাক্কুল ওয়ালে দায়িন) মা-বাবার খেদমত হজের চেয়ে গুরুত্ব বেশি। তাই মা-বাবার খেদমত করা আপনার ওপর দায়িত্ব বেশি। তবে এর বাইরে হলে আপনার ওপর হজ পালন করা বেশি গুরুত্ব হবে।
যদি কোনো ভাই এভাবে সালাম দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি শুধু ‘ওয়ালাইকুম’ বলে উত্তর দিয়ে দেবেন। আর যদি কোনো ভাইকে সালাম দিতে হয়, তাহলে ‘আসসালামু আলা মানিত্তা বাল হুদা অথবা আসসালামু আলাইকুম’ এতটুকু আপনি বলেন বলতে পারবেন।
প্রশ্ন : হুজুর, আমি সেলিমা রহমান, কলাবাগান থেকে। আমার এবারও দুটি প্রশ্ন হজ-সংক্রান্ত। প্রথম, হজের আমাদের ওমরার নিয়তটা যদি আপনারা বলে দিতেন। আমরা নিয়তটা করব এহরামটা বাঁধব।
দ্বিতীয়, আমরা মহিলারা জামাতে নামাজ পড়ার নিয়মটা বেশির ভাগই জানি না। কীভাবে জামাতে সালাত আদায় করব, যদিও আমার তেমন সমস্যা হয়নি। আমি বাংলাদেশ থেকে জেনে গিয়েছিলাম এবং আমি তাদের কথা শুনিনি, আমি আমার গ্রুপের মহিলাদের নিয়ে বোরখা হিজাব পরে ওখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার চেষ্টা করেছি। আমি দেখেছি ওনারা জামাতে নামাজ আদায় করার নিয়মটা জানেন না।
উত্তর : আসলে এই বিষয়গুলো বিস্তারিত জানার জন্য বিভিন্ন বই পড়তে হবে। শুধু প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা জানাতে পারব না। ওমরার নিয়ত বলতে যেটা বোঝায়, সেটা তো একদম সহজ বিষয়, এহরাম এইটাই মূলত নিয়ত। এহরামের মধ্যে দুটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত, এহরাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই পয়েন্টটি আমরা অনেকে জানি না। আমি, বিশেষ করে হাজি সাহেবদের সঙ্গে আলোচনা হয় এবং তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়, তখন আমি জিজ্ঞেস করতাম এবং জানতে চাইতাম, আপনি কীভাবে নিয়ত করেছেন? তিনি তখন কোনো নিয়তই করেন নাই। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক নম্বর নিয়তের মূল কথা সেটা হচ্ছে (তায়েয়ুন নুসুক) তিনি তাঁর নুসুকটাকে নির্দিষ্ট করবেন। তিনি ওমরা করছেন না হজ করছেন, না হজে ওমরা করছেন, নাকি শুধু তামাত্তু হজ করছেন, না শুধু হজ করছেন। এই জিনিসটা তাঁকে সর্বপ্রথম নিজে নির্ধারণ করে নিতে হবে। যদি শুধু ওমরার জন্য হয়ে থাকে যে আমি শুধু ওমরা করার জন্য মনস্থ করেছি, সেটি তিনি অন্তরের মধ্যে সংকল্পবদ্ধ হবেন এবং সেটা সিদ্ধান্ত নেবেন। এটা আরবিতে বলা হয়ে থাকে (তায়েয়ুন নুসুক) মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করা। দ্বিতীয় হলো, তিনি যদি ওমরার জন্য শুধু নিয়ত করে থাকেন, তাহলে (আল্লাহুমা লাব্বাইকা ওমরাহ অথবা আল্লাহুমা লাব্বাইকা উমরাতান আন নাফসি) এইটা নিজের পক্ষ থেকে হলে। আর অন্যের পক্ষ থেকে হলে (আল্লাহুমা লাব্বাইকা উমরাতান আন ফুলান) তাঁর নাম উল্লেখ করতে হবে। আর এই জিনিসটুকু মুখে উচ্চারণ করতে হবে, যেহেতু রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন এ বিষয়ে আসম্মা বিনতে ওমেস (রা.)-কে এবং অন্যান্য সাহাবিকে যখন শিক্ষা দিয়েছেন, তখন রাসূল (সা.) মুখে উচ্চারণের কথা বলেছেন। তাই এটি মুখে উচ্চারণ করাটা রাসূল (সা.)-এর বিধান এবং সুন্নাহ। তিন নম্বর পয়েন্টের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তালবিয়া শুরু করবেন (লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা সারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়া নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুল্লক লা সারিকালাক) তখন থেকে তিনি তালবিয়া শুরু করবেন একেবারে আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ শুরু করা পর্যন্ত। যিনি ওমরার নিয়ত করবেন, তিনি এই সময় থেকে যতটুকু সময় পাবেন পুরা সময়টুকু আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত। হাজরে আসওয়াদের কাছে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলার আগ পর্যন্ত তিনি তালবিয়া পাঠ করতে থাকবেন।
ইমামের সঙ্গে যেহেতু আমাদের দেশের বোনেরা চর্চা করেন না, ফলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে এগুলো জানেন না। ইমামের সঙ্গে সালাত আদায় করার মৌলিক কথা হচ্ছে রাসূল (সা.) সহি মুসলিম হাদিসের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, (ইন্নামাউয়েরাল ইমামুলি ইয়ুতামা বিহি) ইমামকে অনুসরণ করার জন্য মূলত ইমাম নির্ধারণ করা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, (ফাইজা ক্কাবার ফাক্ববেরু) যখন তাকবির দেবে তখন তোমরা তাকবির দেবে (ওয়া ইজা আরকায়া ফার কায়ু), যখন রুকু করবে তোমরা রুকু করবে (ওয়াইজা সাজাদা ফিস সুজুদু), যখন সিজদা করবে তখন সিজদা করবে। অর্থাৎ ইমাম করার পরে অনুসরণ করবেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) ইমামের সঙ্গে অনুসরণের কথা উল্লেখ করেন নাই। যেমন ইমাম যখন সূরা ফাতেহা পড়বে আপনি সূরা ফাতেহা পড়বেন, তারপর (ফাইজা কার আ ফাআনসেতু), যখন কেরাত পড়বে তখন আপনি চুপ থাকবেন। রুকু ও সিজদার মধ্যে যখন তাসবিহ পড়বেন, তখন আপনি তাসবিহ পড়বেন। তাসাহুদ এবং দোয়া পড়বেন, তখন আপনিও পড়বেন। কিন্তু ইমামের সঙ্গে পড়তে হবে, যদি চুপ করে থাকেন, তাহলে আপনার সালাত হবে না।
প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম, আমি চট্টগ্রাম থেকে আরিফ বলছি। আমার প্রশ্নটা হজ ও ওমরার সঙ্গে সম্পর্ক নাই, এটা জানার জন্য। অপ্রাপ্তবয়স্ক কারো ওপর জাকাত ফরজ কি না, এটার বিধানটা একটু বলবেন।
উত্তর : জাকাতটা আসলে ব্যক্তির ওপর ফরজ হয় না। এই ভাইয়ের সম্ভবত জাকাতের মাসয়ালা সম্পর্কে আগে হয়তো স্পষ্ট জানা ছিল না। জাকাত কোনো ব্যক্তির ওপর ফরজ হয় না, জাকাত ফরজ হয় সম্পদের ওপর। যদি অপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সম্পদের মালিক হয়ে থাকে এবং সে সম্পদ যদি তার কর্তৃত্বে থাকে মানে তার অভিভাবকের কাছে থাকে, তাহলে তার অভিভাবককে তার সম্পদের জাকাত দিতে হবে। এবং সেটা যদি নিসাফ পরিমাণ থাকে, তাহলে অবশ্যই তার ওপর জাকাত ফরজ হবে।
প্রশ্ন : হজ কারা করবেন, ওমরা কারা করবেন?
উত্তর : ধন্যবাদ, এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হজ এবং উমরাহ মূলত আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালা যাঁদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন এবং ইসলামের সমস্ত ইবাদত ফরজ হওয়ার জন্য মৌলিক কয়েকটি শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে তাঁকে মুসলিম এবং মুমিন হতে হবে। কোনো ব্যক্তির যদি অন্তরের মধ্যে ইমান ও ইসলাম না থাকে এবং তিনি যদি মুসলিম না হয়ে থাকেন অথবা ইসলামের কথা ঘোষণা করে থাকেন এবং ইসলামের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কপটতা রয়েছে, তাঁর ওপর হজ ফরজ না এবং তিনি যদি হজ পালন করে থাকেন, তাহলে তিনি হজের ফজিলত পাবেন না।
দ্বিতীয়, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া এটা বলতে বোঝায় যে ব্যক্তি দুটি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন এমন। এ ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও যেটি বিশুদ্ধ অভিমত হজরত আবু দাউদ (রা.)-এর হাদিস দ্বারা বর্ণিত হয়েছে সে হচ্ছে ১০ বছর। যদি কেউ এই বয়সে উন্নীত হয়ে থাকে, তাহলে সে হজ পালন করে থাকে, তাহলে তার হজ গ্রহণযোগ্য হবে, যেহেতু সে এই বয়সের মধ্যে হজ করতে পেরেছে। এটা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া।