স্বাধীন ভাবনা
সর্বজনের শক্তি
একটা সময় ছিল, যখন এ দেশের সাধারণ মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেরাই হিসাব করতে চাইতেন যে মুক্তিযুদ্ধের ফলে তারা কী পেলেন আর কী পাননি। এখন বোধকরি সেই হিসাবটুকুও করার আগ্রহটা তাদের নষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে ঠিক রবীন্দ্রনাথের ‘কী পাইনি তারি হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’র ব্যাপার বলা যাবে না। কারণ, দিনশেষে যখন দেখা যায় যে প্রাপ্তির ঘরে সেই একই রকম শূন্য; সবখানেই না-পাওয়ার একই রকম ইতিকথা, তখন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কী পেলাম আর কী পেলাম না, হিসাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।
কারণ, নানা রকম অপ্রাপ্তি-বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করে হিসাবের সেই আগ্রহটাই তাঁদের নষ্ট হয়ে যায়। আবার এর উল্টো দিকও রয়েছে। এটিও সত্যি যে মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেকেই তার ফসল দুই হাতে তুলতে পেরেছে। তাদেরই বড় একটা অংশ স্বাধীনতার পর থেকেই শাসক-মহলের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এদের বড় একটা অংশ পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিল। এদের মুখ থেকেই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা কতভাবেই না শুনতে পাই! যদি প্রশ্ন করা হয়, এই চেতনাটি আসলে কী? তাহলে তারাও জনগণকে কোনো স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এই দিক দিয়ে পাকিস্তান আমলের শাসকশ্রেণির সঙ্গে এখনকার শাসকশ্রেণির একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখতে পাই। পাকিস্তানি শাসকমহল নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতার দায় ঢেকে রাখবার জন্যে কথায় কথায় অখণ্ড পাকিস্তানি-চেতনার কথা বলত; পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখবার ব্যাপারে, তার অখণ্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে নানা মাত্রায় জোর দিত।
তাদের সেই জোর দেওয়ার মূল কারণ ছিল জনগণের দৃষ্টিটাকে শোষণযন্ত্র থেকে ভিন্নদিকে সরিয়ে রাখার একটা অপকৌশল। আমাদের বর্তমান শাসক-শোষকশ্রেণিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে, নানাভাবে সেই কৌশলটাকেই কাজে লাগিয়ে চলেছে। এইদিক থেকেও, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির সঙ্গে, আজকের শাসকশ্রেণির একটা নিবিড় ঐক্য দেখতে পাই। শুধু এই দুই আমলের কথাই বা বলি কেন। যুগে যুগে শোষক-শাসকরা মূলত একই শ্রেণির, একই গোত্রের। এই একই চেতনায় ভর দিয়েই তারা শক্তি অর্জন করতে থাকেন। আবার, এর বিপরীতে সর্বজনেরও একটা শক্তি আছে, শক্তি থাকে। সেইটা অনেকসময়ই দৃশ্যমান নয়। কিন্তু কাজের মতো কাজে নামলে সেই অদৃশ্য শক্তিটাকেও টের পাওয়া যায়। একাত্তরে আমরা নানামাত্রায় সর্বজনের সেই শক্তিটাকে দেখেছি। বলা যায়, জনগণের সেই শক্তিই সেই সময়কার পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি আর তার আন্তর্জাতিক মিত্রদের যাবতীয় শক্তির হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। খানিকটা হলেও সেই শক্তিটাকে, এবার এই ২০১৬ সালে, স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।
২.
গত ৬ নভেম্বর ‘রংপুর চিনিকলে’র সাহেবগঞ্জের বাগদাফার্ম এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী সাঁওতালদের ওপর নির্বিচারে হামলা করা হয়। সেই হামলায় মদদ দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন। এতে তিনজন আদিবাসী নিহত হন, আহত হন অনেকেই। শুধু তাই নয়, নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এই এলাকার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে। আহত কয়েকজনকে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমাদের কাছে এইটুকুই ছিল খবর। বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও এরচেয়ে বেশি কিছু জানার উপায় ছিল না। এই সংবাদটুকু পেয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু উদ্যমী ছাত্র-শিক্ষক সাহেবগঞ্জের সাঁওতালদের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে, ক্যাম্পাসের ভেতর থেকেই অর্থকড়ি-শীতবস্ত্র সংগ্রহের একটা মানবিক উদ্যোগ নেন। সাত দিনের প্রচারণায় যে-অর্থ হাতে আসে, সেটা দিয়ে ৫০টি ‘সহায়তা-প্যাকেট’ তৈরি করা হয়। প্রতিটি প্যাকেটে ছিল তিন কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, আধা কেজি লবণ ও আধা লিটার সয়াবিন তেল। এইসব ‘প্যাকেট’ আবার ভরা হয় চটের ছয়টি বড় বস্তায়।
৩.
রাজশাহী থেকে রংপুরগামী বাসে টিকেট কাটতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, এসব বস্তায় কী আছে? আমাদের এও বলা হয় যে বাসে এতগুলো বস্তা তুলতে হলে জনপ্রতি ভাড়াসহ বাড়তি টাকা দিতে হবে। তখন বলা হলো, আমাদের এই ছয় যাত্রী গোবিন্দগঞ্জে যাবেন। গোবিন্দগঞ্জের কোথায়? বাগদাফার্মে। ওখানে তো খুব গণ্ডগোল। এখন কেন যাচ্ছেন? কাউন্টারের ভেতর থেকে গলার স্বর ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে। জানানো হলো, আদিবাসী সাঁওতালদের জন্যে সামান্য কিছু খাবার নিয়ে যাচ্ছি। বেড়াতে যাচ্ছি না। আমাদের অবাক করে দিয়ে জানানো হলো যে বস্তার জন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হবে না। যদিও কয়েকজন কুলি তাঁদের হিসাবে বস্তাপ্রতি ‘প্রাপ্য টাকা’ না-পেয়ে একটু উত্তেজিত ছিলেন। বাস থেকে গোবিন্দগঞ্জে নামার পর ওখানকার কুলিদেরও বস্তা নিয়ে টানাহেঁচড়া। কিন্তু ‘রিলিফ’ নিয়ে বাগদাফার্মে যাচ্ছি বলতে নিমেষেই সব শান্ত হয়ে এলো। আশপাশের মানুষগুলোর চোখে কৌতূহলের বদলে দেখতে পাই সহানুভূতির ছায়া। কাপড় আর খাবারের বস্তা একটা ভ্যানে তোলা হলো। আমরা কয়েকজন উঠলাম একটা অটোরিকশায়। অটোচালক নানা রকম কথা বলছেন। আমাদের দিক থেকে ফার্মের গোলযোগের কথা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়া হলো। অটোচালকও এড়িয়ে গেলেন। এদিকে অটো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও অন্যদিকে ভ্যানের দেখা নেই। দুজন বাদে বাকিরা নেমে আবার পেছনে গেলেন ভ্যানের খোঁজ নিতে। অটো থেমে আছে। আমরা দুজন বসে আছি। সময় কাটাতেই যেন ভ্যানচালককে জিজ্ঞাসা করি, আপনার নিজের ভ্যান? মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি হ্যাঁ-বাচক উত্তর দেন। ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ আর ‘আশা’ থেকে ঋণ নিয়ে এই অটো কিনেছেন। প্রতি সপ্তাহে ‘কিস্তি’ জমা দিতে হয়। দিয়ে হাতে তেমন কিছু থাকে না। কোনোমতে দিন চলে যায়।
অটোচালক এবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, কোথা থেকে আসছি। কোথায় যাবো। বস্তায় কী আছে? আমরাও অল্প অল্প মুখ খুলি। পুরোটা নয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছায়াটা তখনো কাটেনি। অটোতে তুলেছিলাম কাপড়ের একটা বস্তা। সেইটা দেখে অটোচালক বললেন, এটাতে কী? কাপড়। কাপড় নিয়ে এসেছেন ভালো; কিন্তু কিছু চাল-ডাল আনলে আরো ভালো হতো। কেন? চাল-ডালের কথা বলছেন কেন? না। শুনতে পাই সাঁওতালদের এখন দরকার খাবারের। ওদের ওখানে নাকি আজ কদিন ঠিকমতো তেমন কিছুই রান্নাই হচ্ছে না। বেচারারা না খেয়ে আছে। কে বলে কেউ কিছু জানে না? ধীরে ধীরে অটোচালক অনেক কথাই বললেন। আমরাও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকি। দ্রুতই দুপক্ষের একটা সংযোগ-সূত্র তৈরি হতে থাকে। অন্যায়ভাবে এলাকার কিছু অর্থবান আর দাপুটে মানুষকে জমির লিজ দেওয়া নিয়ে যে যত গণ্ডগোল, সেটাও জানতে পারি। এর সঙ্গে ফার্মের কর্তাব্যক্তি আর স্থানীয় রাজনীতিবিদদের যোগসাজশের কথাও অটোচালক বলতে শুরু করলেন।
এর মধ্যে শুকনো খাবারের ভ্যান এসে পৌঁছায়। অটোচালক এবার নিজের উদ্যোগেই বস্তাগুলো অটোতে তোলা শুরু করলেন। কেননা, এই রিলিফগুলো মানুষ-টানা ভ্যানে করে সাঁওতালদের ওখানে নিয়ে যেতে যে অনেক সময় লাগবে। এগুলো নিয়ে যাওয়ার পুরো দায়টা যেন তাঁর, সেই অটোচালকের।
৪.
এরপর প্রধান সমস্যা দাঁড়াল ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ-হওয়া সাঁওতালরা ঠিক কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি খুঁজে বেরা করা। এই এলাকায় আমরা কেউই আগে আসিনি। অটোচালকও ঠিক জানেন না উদ্বাস্তু সাঁওতালদের বর্তমান ঠিকানা। কিছুদূর যেতেই পুলিশের একটি দলের দেখা মিলল। তাদের থেকে একটু দূরে কয়েকজন সাধারণ মানুষ। এখানে সাঁওতালরা এখন কোথায় আছে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, এখানে এখন কোনো সাঁওতাল নেই। সবাই চলে গেছে। চলে গেছে? হুম। কোথায় গেছে? ঝামেলা সব মিটে গেছে তো। সে কারণে ওরা চলে গেছে। অটোচালক কিংবা আমরা কেউই সেই কথায় কান দিই না। ঠিক ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না জেনেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকি।
সামনে খানিকটা যেতেই একজন সাধারণ দরিদ্র মহিলার দেখা পাই। তাঁর সঙ্গে দুটি সন্তান। সাঁওতালদের কথা জিজ্ঞেস করতেই গলা বেশ খানিকটা নামিয়ে বললেন, ওরা সবাই মাদারপুরে আছে। আপনারা মাদারপুর ইশকুলে যান। ওখানে পাবেন। এটুকু বলেই কথা আর না বাড়িয়ে তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যান।
এমনভাবে যেতে থাকেন যেন আমাদের সঙ্গে তাঁর কোনো কথাই হয়নি। পরে দেখা গেল, ওই দরিদ্র নারী যে তথ্য দিয়েছিলেন, সেটিই প্রায় শতভাগ সঠিক। বসতভিটা থেকে উৎখাত হওয়া সাঁওতালদের একটি অংশকে আমরা মাদারপুরেই পেয়ে যাই। পরে সেখান থেকে যাই জয়পুর এলাকায়। সেখানেও আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। তাঁদের কারোরই মাথার ওপর ছাদ নেই; খাবার নেই; গায়ে শীতের বস্ত্র নেই। এলাকার পুরুষরা, বিশেষ করে তরুণ-যুবকরা কেউ পুলিশের ভয়ে, কেউ আবার প্রাণের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বৃদ্ধ-নারী-শিশুরা একটা নিদারুণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। হেঁটে হেঁটে দেখতে থাকি পাকা ধানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত। তার চারপাশে ফার্ম কর্তৃপক্ষের সদ্য তোলা কাঁটাতারের বেড়া। নির্বিচারে কেটে ফেলা ফলফলাদির গাছ। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনের নিভন্ত, ঠান্ডা ছাই। বসতভিটার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া ট্রাক্টরের চাকার স্পষ্ট দাগ। প্রশাসন আর ফার্ম কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না; কিন্তু কোনো কিছুই তাদের সেই অত্যাচারের চিহ্ন গোপন করতে পারেনি। অত্যাচারের চিহ্ন কি কখনো গোপন থাকে! সাঁওতালদের উচ্ছেদের চিহ্নগুলোর নমুনাগুলো দেখতে দেখতে আমরা মূলত একাত্তরকেই যেন আরো একবার দেখতে পাচ্ছিলাম। আর সেটি এই স্বাধীন দেশের মাটিতেই!
৫.
এই যে বাসস্ট্যান্ডে, অটোতে, রাস্তায় যাঁদের দেখা আমরা পেয়েছিলাম, এঁরাই হলেন দেশের সেই সর্বজন। যাঁরা নিজেরাও ভীষণভাবে শোষিত; কিন্তু প্রাণের সেই উত্তাপ হাজারো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও তাঁরা ঠিকই ধরে রেখেছেন। তাঁদের ভেতরের শক্তি হয়তো বয়সের ভারে অনেকটা মিইয়ে গেছে, কিন্তু তাতে তেমন একটা মরিচা ধরেনি। এই সর্বজনকে বাদ দিয়ে দেশের কোনো উন্নয়নই আজকে আর উন্নয়ন বলে গণ্য হবে না। এইটি, স্বাধীনতার এই এতগুলো বছর পরেও, যদি বুঝতে না-শিখি তাহলে আমাদের মতো হতভাগা আর কেউ নেই। মানবজাতির এক মহান শিক্ষক বলেছিলেন, ‘এই দুনিয়া হচ্ছে গণসংগ্রামের মহান দুনিয়া।’ দেশের এবং দুনিয়ার অন্যান্য নিপীড়িত সর্বজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই গণসংগ্রামের পথেই হাঁটতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।