দৃষ্টিপাত
দুর্ভোগের শেষ কোথায়?
২৪ অক্টোবর, সকাল সাড়ে ৯টা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনে ভিড় করছেন অনেক ভর্তিচ্ছু। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন অভিভাবকরা। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ ঘাসের ওপর বসে- অনেকেই আবার বেঞ্চ বা চেয়ারে বসে শরীরের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছিলেন। ভর্তিচ্ছুরা বইপত্র পড়ছিলেন আর ভ্রমণের ধকল কাটাতে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছিলেন।
এমন সময় হঠাৎ চোখ আটকে গেল ভবনের সামনে ইট-সিমেন্টের তৈরি এক বেঞ্চের দিকে। এক ভর্তিচ্ছু বেঞ্চ থেকে আচমকা মাটিতে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চের একপ্রান্তে বসে থাকা ওই ভর্তিচ্ছুর ‘মা’ সন্তানকে মাটি থেকে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। মায়ের সাহায্য নিয়ে ছেলেটি মাটি থেকে উঠে আবারও বেঞ্চে বসেন।
ভর্তিচ্ছু ছেলেটি রাতে দূর থেকে ভ্রমণ করে আসার কারণে ক্লান্তিতে ঝিমুচ্ছিলেন। বেঞ্চে বসার একটু সুযোগ পেয়েই কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গেছে তিনি বুঝতেই পারেননি। সে কারণেই হয়তো মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চোখ দুটি লাল টকটকে দেখাচ্ছিল ওই ভর্তিচ্ছুর। চোখে-মুখে বাড়তি ক্লান্তির ছাপ। মাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ঢাকা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছেন তিনি। এমন হাজার হাজার সন্তান দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করতে সহ্য করেছেন অমানুষিক কষ্ট।
শুধু দূর থেকে আসা ভর্তিচ্ছু ও তাঁদের অভিভাবকদেরই কষ্ট করতে হয় বিষয়টি এমন নয়। ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে রাজশাহী শহরের বাসিন্দারাও নানামুখী জটিলতায় পড়েন। শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সব খাবারের দাম বেড়ে যায়, রিকশা বা অটোরিকশায় উঠতে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল ও পার্শ্ববর্তী মেসে স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি মানুষ অবস্থান করেন। এতে করে স্বভাবতই ভর্তি পরীক্ষার সময় এই শহরে সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন জটিলতা।
এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদে (বি-ইউনিট) মধ্যে দিয়ে প্রথম ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। ২৪ অক্টোবর সকাল ৯টায় শুরু হয় এ পরীক্ষা। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য দেশের বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৫৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে মোট চার হাজার ৭১৩টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে এক লাখ ৭৮ হাজার ৯৪৯টি। ২৭ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টায় চারদিনব্যাপী ভর্তি পরীক্ষা নামক দুর্ভোগ শেষ হয়।
এর পরের দিন (২৮ অক্টোবর) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। ওই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যাঁরা ফরম তুলেছিলেন, তাঁদের ৭০-৮০ ভাগ ভর্তিচ্ছু রাজশাহী থেকে ঢাকায় গিয়েছেন। তাই ২৫, ২৬ ও ২৭ অক্টোবর রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সব বাস বা ট্রেনের টিকেট এক সপ্তাহ আগেই শেষ হয়ে যায়। অনেকেই আবার বাসের টিকেট সংগ্রহ করেও ঢাকায় যেতে না পারায় ২৭ অক্টোবর রাতে রাজশাহী নগরীর বিনোদপুরে রাস্তা অবরোধ করেন। পরে উপায় না দেখে অনেক শিক্ষার্থী বাস ও ট্রেনের ছাদে যাত্রা করেন ঢাকার উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে তাঁরা কতটা নির্বিঘ্নে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পেরেছেন তা আমাদের জানা নেই।
এই ভর্তি পরীক্ষা নামক যাতনা থেকে শিক্ষার্থীদের যদি মুক্তি দেওয়া যেত তাহলে খুব ভালো হতো। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার মতো যদি গুচ্ছ পদ্ধতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যেত তাহলে এই দুর্ভোগ কমে যেত। শিক্ষার্থীরা নিজ জেলায় বসে শান্তিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকা অনুযায়ী পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতেন। এতে করে গরিব পরিবারের সন্তানদের টাকা ও শ্রম দুটোই বাঁচত। কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এ বিষয়ে এখনো একমত হতে পারেননি।
নানা দুর্ভোগ ও অর্থ খরচের পর একজন শিক্ষার্থী মেধার জোরে জায়গা করে নেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মনে সৃষ্টি হয় একধরনের আত্মতুষ্টি। যা বিরাজ করে তাঁদের অভিভাবকদের মধ্যেও। কিন্তু আসলেই কি আত্মতুষ্টির কোনো ব্যাপার আছে এতে? তা বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করে শিক্ষার্থীরা কী করছেন? এই সনদপত্র কি তাঁদের কর্মজীবনে প্রবেশ করাতে পারছে? নাকি তাঁদেরকে নতুন করে আবারও দুর্ভোগে ফেলছে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অনেক আগেই হয়তো এসেছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে আমাদের সরকার। বিশ্বব্যাংকও তাদের সুবিধামতো পর্যায়ক্রমে ঋণ দিচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে। এই ঋণ দিয়ে এখন শিক্ষার মানের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে ঠান্ডা বাতাস পাওয়ার জন্য লাগানো হচ্ছে এসি। শিক্ষার উচ্চতা এখন নির্ধারিত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে। বইপত্র দিয়ে নয়। হেকেপের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনার করছেন। ঋণের টাকায় নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে মুখে বলছেন শিক্ষার উন্নয়নের কথা। হ্যাঁ মানছি, তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষাকে তুলে ধরতে হবে। বিশ্বে তাই হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে বইপত্র কেনা বাদ দিয়ে কি শিক্ষার মান ও গবেষণা বাড়ানো সম্ভব হবে? গত ১০ বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কত কোটি টাকার বই ক্রয় আর কত লক্ষকোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন বা এসি কেনা হয়েছে তা খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে।
শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ বয়সটি ব্যয় করেন। এই বয়সের শিক্ষার্থীদের দ্বারা অনেক কিছুই করিয়ে নেওয়া সম্ভব। সঠিক পরামর্শ ও উপদেশ পেলে এই শিক্ষার্থীরাই হতে পারতেন দেশের মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু বর্তমান চিত্র আমাদের তেমন আশার বাণী শোনাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা পাচ্ছেন তা হয়তো তাঁদের সঠিক পথে নিতে পারছে না। তাই শিক্ষার্থীও এখন নানামুখী অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছেন। যদিও এই সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোতে মেধার চর্চার বদলে এখন হচ্ছে নোট বইয়ের প্রসার। শিক্ষকরা যেমন পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে আসছেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও। এর পরও কিছু শিক্ষক আছেন যাঁরা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন শিক্ষা ও গবেষণায়। তা একান্ত নিজস্ব উদ্যোগেই বলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক একদিন গল্পের ছলে বলছিলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে বিভাগের পড়াশোনা করার মতো শিক্ষার্থী খুব একটা পাচ্ছেন না। বিভাগের পাঠ্যবই বা অন্য জ্ঞানমূলক বইয়ের পড়াশোনার বদলে শিক্ষার্থীরা এখন শ্রেণিকক্ষে পড়ছেন সাধারণ জ্ঞানের বই। উদ্দেশ্য চাকরি।‘ এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন ওই শিক্ষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে হয়তো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে চাইছেন। বড় বড় জ্ঞানের বই পড়লে এখন চাকরি বাজারে তাঁদের কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগের চেয়ে চাকরির দিকে বেশি ঝুঁকছেন। তাই জনগণের টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর উদ্দেশ্য এখন ব্যাহত হচ্ছে বৈকি।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখন চাকরির পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা বিভাগের পড়াশোনা বা নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আর তেমন নিজেকে জড়াতে চাচ্ছেন না। কীভাবে একটা ভালো চাকরি পাওয়া যায়, সে জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকছেন। সেই সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ভেতরে গড়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার। যা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো দেখা যাবে। এই ক্যাম্পাসে এখন তিনটি চাকরির পরামর্শ দানকারী কোচিং সেন্টার রয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন কোচিংয়ের পড়াশোনায়। আমাদের মতো গরিব দেশের নাগরিকরা শিক্ষাজীবন শেষে একটা ভালো চাকরি পাবেন এটাই তো ইচ্ছা।
একজন সন্তানকে ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলা চুকিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর টাকা খরচ করে পড়ান তখন অভিভাবকরা আশায় থাকেন ওই সন্তানটি ভালো একটি চাকরি পাবে। কিন্তু বর্তমান বাজারে যত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের হয়তো ১০ ভাগ ভালো চাকরি পাচ্ছেন। তাহলে বাকি ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর দুর্ভোগ কে দেখবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সম্প্রতি তাঁর নিজস্ব ফেসবুক পাতায় একটি স্ট্যাটাস দিয়ে সেখানে বলতে চেয়েছেন, ‘বিসিএস পরীক্ষার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এইচএসসি করলে মন্দ হতো না! তাদের জন্য আর্মির মতো চাকরি ও প্রশিক্ষণকালীন অন্যান্য একাডেমিক ডিগ্রি নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত। এতে করে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় ঠেকানো যেত...।’ তিনি হয়তো বর্তমান বাজারে চাকরির যোগ্যতা ও শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার কারণেই এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। চাকরি বাজারে যে একাডেমিক জ্ঞানের দরকার হয় না, তিনি সেটিও বলেছেন। এখন এমনও হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এসএসসি পাস যোগ্যতার পদে আবেদন করছেন শিক্ষার্থীরা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি শিক্ষার্থীর ভর্তি না করিয়ে সংশ্লিষ্ট পদে যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন চাইলেই ঝামেলা মিটে যায়। তাহলে রাষ্ট্রের খরচ অনেকাংশেই বাঁচত।
তাই শুধু শিক্ষার্থীদের কষ্ট বাড়িয়ে তাঁদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। শিক্ষাকে জীবন ও মানবমুখী করতে না পারলে ভবিষ্যতে মেধা কিনতে হবে অন্য দেশ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এসব বিষয় নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি সরকারের কাছে প্রস্তাবও রাখতে হবে। মূল সংকটটি বোধহয় এখানেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকই এখন সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো প্রস্তাব দিতে পারছেন না। কর্মজীবন নিয়ে অন্ধকারে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাই শুধু ভর্তি পরীক্ষার দুর্ভোগ কাটালেই হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু নবীন শিক্ষার্থীদের সামনের দিনের কঠিন দুর্ভোগের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে রাষ্ট্রকেও।
লেখক : সাংবাদিক