অভিমত
তিস্তাকে কেন জাতীয় নদী করার দাবি?
আমাদের ফুল-ফল, পশু-পাখি, উদ্যানসহ অনেক ক্ষেত্রেই ‘জাতীয়’ স্বীকৃতি আছে। আমাদের নদী প্রশ্নে সেই ‘জাতীয়’ স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ। আমাদের জীববৈচিত্র্য আমাদের জীবিকা সবকিছুর সঙ্গে নদনদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমাদের দেশ ছিল সহস্রাধিক নদনদীর দেশ। সেই সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে আমরা নদীকে আমাদের জীবনের কাজে ব্যবহার করিনি। নদী ব্যবহারে আমাদের সব রকম সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা নদীকে আপন না করে দূরেই ঠেলে দিয়েছি। নদী আমাদের অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ—এ কথা আমরা মুখে বললেও এখনো কার্যত স্বীকার করি কি-না সন্দেহ। তা না হলে আশীর্বাদকে কেউ পায়ে ঠেলে দিতে পারে?
আমাদের দেশে যেসব বিষয়ের সঙ্গে ‘জাতীয়’ প্রসঙ্গটি আছে, সেসবের প্রতি আমাদের ঐক্যবদ্ধ একটি ভালোবাসা আছে। জাতীয় ফুলটার প্রতি এক প্রকার বিশেষ ভালোবাসা উপলব্ধি করা যায়। আমাদের যদি যেকোনো একটি জাতীয় নদী থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সেই নদীকে দূষণমুক্ত রাখা হতো। নিশ্চয়ই সেই নদীকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হতো। সেই নদী হয়ে উঠত আমাদের বিনোদনের অন্যতম স্থান। পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হতো। প্রতিবছর প্রয়োজনীয় খনন করা হতো। যেহেতু জলের স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকত, তাই সে নদীটির বুক বেয়ে চলত নৌযান। সেই নদীতে প্রচুর মাছ চাষ হতো। এককথায় নদীটি পেত তার সব ধরনের অধিকার। সে কারণে আমরা একটি জাতীয় নদীর দাবি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে।
তিস্তা নদীকে জাতীয় নদী হিসেবে ঘোষণার যে দাবিটি উত্থাপন করা হয়েছে, তার নেপথ্যে অনেক কারণ বিদ্যমান। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। তিস্তার অনেক শাখা নদী আছে এবং তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। তিস্তা নদীর জলপথ ব্যবহার করে দেশের সব প্রান্তে যাওয়া সম্ভব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত সাতটি প্রদেশের দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর মুনাফা করতে পারবে। তিস্তার পানিই রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হওয়ার আগে তিস্তাপাড়ের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তিনবেলা করে খাওয়ার সুযোগ পেত না। তাঁরা তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছেন তিস্তা সেচ প্রকল্পের কারণে।
তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। তিস্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন। এই তিস্তার আজ মরণদশা। যদি তিস্তাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়, তাহলে সরকার তিস্তাকে করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে না। ভারত যে অন্যায়ভাবে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে তিস্তাকে মৌসুমি নদীতে পরিণত করছে, তার বিরুদ্ধে সরকারও রুখে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় নদী জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই নদী দেশের যেকোনো নদীই হতে পারে। যেমন কুলিক বাংলাদেশের একমাত্র নদী, যেটি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপন্ন হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এ নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা যেতে পারে। জনজীবনে দেশের সব নদনদীর কোনো কোনো ইতিবাচক প্রভাব আছে। দেশের যেকোনো একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করে সেই নদীকে আদর্শ নদীতে পরিণত করা সম্ভব।
জাতীয় নদী ঘোষণা প্রক্রিয়াটির প্রতি সরকারের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়; বরং জাতীয় নদী ঘোষণা সরকারের অনেক বড় অর্জন হিসেবেই পরিগণিত হবে। বাংলাদেশে যাঁরা নদী নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাছে ‘জাতীয় নদী’ স্বপ্নপূরণের সমান বলে বিবেচিত হবে।
নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের সংগঠক হিসেবে এটুকু অনুমান করতে পারি, যদি একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেই নদী সরকারের সব রকম যত্ন পাবে। সব রকম যত্ন পেলে আমরা একটি আদর্শ নদী পাব। এই আদর্শ নদীটিই আমাদের পথ দেখাবে অন্য নদীগুলোকেও আদর্শ নদীতে পরিণত করার।
বিশ্ব নদী দিবস ২০১৬ পালিত হলো গত ২৫ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব নদী দিবসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের রিভারাইন পিপল অনেক যৌক্তিকতার নিরিখে তিস্তাকে জাতীয় নদী করার দাবি জানিয়েছে। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টির প্রতি কার্যকর দৃষ্টি রাখবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।