সমসাময়িক
আবারো বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি
বৃহস্পতিবার আরেক দফা গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ২.৯৩ শতাংশ হারে আর গ্যাসের দাম ২৬.২৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হলো। যার ফলে গ্যাস ব্যবহারে এক চুলার কানেকশনে ৬০০ টাকা আর দুই চুলার কানেকশন ৬৫০ টাকা হবে। যে মূল্য এর আগে ছিল যথাক্রমে ৪০০ টাকা ও ৪৫০ টাকা।
বর্ধিত এ মূল্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও, যেমন—গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের বিল প্রতি ঘনমিটার পাঁচ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বেড়ে সাত টাকা, সিএনজির প্রতি ইউনিটে দাম বেড়ে পাঁচ টাকা। সে হিসাবে, প্রতি ইউনিটের দাম হবে ৩৫ টাকা, যা আমাদের নিত্যদিনের চলাচলকে ব্যাহত করবে। এমনিতেই বাড়িভাড়ার পাশাপাশি গাড়িভাড়া নিয়ে আমাদের কষ্টের সীমা নেই। এই গাড়িভাড়া শুধু প্রাইভেট গণ্ডিতেই বৃদ্ধি পাবে না। তা বৃদ্ধি পাবে স্বয়ং সরকারি গণ্ডিতেও। বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম বাড়ল, তখন কিন্তু আমাদের বিআরটিসির গাড়িভাড়া বাড়াতে কার্পণ্য করেনি। অবশ্য বেশ কিছু দিন ধরে তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও কমেনি বাংলাদেশে। এ এক আশ্চর্য কাহিনী।
বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি বাড়ানো হয়েছে ১১ টাকা ৩৬ পয়সা। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের সবার ওপরে। কারণ, মালিকপক্ষ যেমন অর্থ ব্যয় করবে, তারা তেমন অর্থ পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে উসুল করে নেবে। আর তাদের কমন চিন্তা বেশি জোগান মানে বেশি লাভ।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১ থেকে ৫০ ইউনিটের ভোক্তাদের জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ বিল গুনতে হবে না। তাদের এ কথা কতটা বাস্তবসম্মত? কারণ, পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে সর্বনিম্ন ৬০ ইউনিট হারে ২৬৫ টাকা নিচ্ছে। সে হিসেবে নতুন এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষকেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। আর একটা কথা না বললেই নয়। এই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে? একজন মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাবে আর সে টিভি, ফ্রিজ ও ফ্যান কিনবে না, তা হয়? এখন তো কিস্তিতে সব পণ্যই পাওয়া যাচ্ছে। একসঙ্গে এসব কেনার সাধ্য না থাকলেও তারা কিছুটা বাড়তি টাকা দিয়ে তা কিস্তিতে ঘরে তুলছে। যার ফলে আজকের প্রান্তিক পর্যায়ের একটি পরিবারের বিদ্যুৎ বিল কালকে একরকম থাকে না। তাদের ঘরে নতুন নতুন বৈদ্যুতিক আসবাব আসছে আর বিদ্যুৎ বিলও বাড়ছে। তাহলে কমিশনের পক্ষ থেকে যে যুক্তি দেখানো হলো তা প্রশ্নাতীত। কারণ, ওই মানুষগুলোর মাসিক বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি পায় না তাদের উপার্জন।
সেচপাম্পের জন্য শহরে দাম ছিল ইউনিটপ্রতি দুই টাকা ৫১ পয়সা, তা বেড়ে হয়েছে তিন টাকা ৮২ পয়সা। ক্ষুদ্রশিল্পে বিদ্যুতের দাম সাত টাকা ৪২ পয়সা থেকে বেড়ে সাত টাকা ৬৬ পয়সা। যেখানে আমাদের কুটিরশিল্পের বেহাল দশা, সেখানে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোমতেই গণমুখী হতে পারে না। সরকারের উচিত হবে এসব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ানো। এর ফলে আমাদের কৃষিশিল্প ও কুটিরশিল্প-হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটবে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের জোগান হবে।
এ নিয়ে ২০০৯ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ল আটবার। সর্বশেষ গেল বছরের মার্চ মাসে বাড়ানো হয়েছিল। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হলো, বিতরণ কোম্পানিগুলো বারবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে আসছে। সবকিছু বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এখানে কী বিবেচনা করা হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ, দাম বাড়ানো নিয়ে জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বিইআরসি গণশুনানি করে। তারা দাম বাড়ানোর পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি; বরং দাম কমানোর যুক্তিগুলোই ছিল জোরালো। তাহলে তারা কি গণমানুষের কথা রাখল নাকি রাখল মুনাফাখোরদের কথা?
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে বলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কমেছে। ফলে দাম বাড়ানোর প্রশ্ন কতটা বাস্তবতার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত, তা কর্তৃপক্ষের ভাবা দরকার। অন্যদিকে মানুষ কেন গ্যাসের বর্ধিত দাম দিতে যাবে? আমাদের দেশের প্রতিটি গ্যাস কোম্পানি লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
যাঁরা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাদের ১৬ কোটি মানুষের কথা ভাবা উচিত। তাঁদের কত কম ব্যয়ে জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, সেদিকে জোর নজর দেওয়া উচিত। খোঁড়া যুক্তি হিসেবে নতুন পে-স্কেলের কথা বলছেন। নতুন এই পে-স্কেল তো ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ ১৬ কোটি মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমাদের খেটে খাওয়া মানুষগুলো এমনিতেই বেশ কষ্টে আছে। শহরের চাকরিরত শিক্ষিত মানুষেরও জীবন যাচ্ছে বেশ কষ্টে। তাঁদের বেতনের প্রায় পুরো অংশ চলে যায় ঘরভাড়া আর গাড়িভাড়ায়। নতুন এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের গুনতে হবে বাড়তি গাড়ি ও বাড়িভাড়া। কারণ, অনেক বাড়িতেই রয়েছে জয়েন্ট মিটার। আবার মালিকপক্ষও এ মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাসাভাড়া বাড়াবে। আর গাড়িভাড়া তো কোন দিক দিয়ে বেড়ে যাবে, তা আমরা টেরই পাব না। নিত্যপণ্যের দামেও পড়বে এর প্রভাব। কারণ, মালিকপক্ষের ওপর পড়বে বাড়তি উৎপাদন ও বিপণন খরচ।
অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে তুলনামূলকভাবে সব জিনিসের দাম অনেক কম। পার্শ্ববর্তী দেশ কলকাতা হয়ে আগ্রা, জয়পুর, দিল্লি, সিমলা, ভুন্তার, মানালি ও জম্মু-কাশ্মীর—সেখানে আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম দামে পেট পুরে খাওয়া যায়। কাশ্মীর থেকে কলকাতা ৪৮ ঘণ্টা স্লিপার ট্রেনের ভাড়া মাত্র ৮৪০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার টাকাও হয় না। পুরো ভারতে ৫৩-৫৪ রুপিতে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে। আবার হিমাচল প্রদেশে তা ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ রুপিতে। কলকাতার ফ্ল্যাট ভাড়া ঢাকার তুলনায় বেশ কম। অথচ তাদের আয় অনেক। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক বছরের বেশি সময় ধরে কমলেও আমাদের বাজারে কমায়নি সরকার। ২০১৩ সালে বাড়ানো হয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। বর্তমানেও প্রতি লিটার অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রল ৯৭ টাকা, কেরোসিন ও ডিজেল ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সরকার তো বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে তেল ব্যবহার করছে, তা আর এ দেশের বাজারদরে কিনছে না। এই তো কয়েক সপ্তাহ ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ৪০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এতে তো বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরো কমেছে। তাই নীতিনির্ধারকদের গণমুখী চিন্তা করা উচিত। এতে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক