জাতীয় কন্যাশিশু দিবস
দুই কন্যাই আমার দুই চোখের আলো
১৯৯৭ সাল, ৪ অক্টোবর, শনিবার। দিনটি আমার জন্য ছিল অন্যরকম একটি দিন। সেদিন সূর্যটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি আলো নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিল। গাছের সবুজ পাতায় সেই আলো পড়ে অপার মায়া তৈরি করছিল। দুপুর ১২টার ঠিক কিছু আগে বা পরে আমার প্রথম কন্যা টুপ করে গাছের পাতা গলে সেই আলোর সাথে পৃথিবীতে পড়ল যেন।
আমার বাবা হওয়ার আনন্দ দেখে কে ? কন্যার মুখ না দেখেই অফিসে সহকর্মীদের মিষ্টিমুখ করিয়েছিলাম। একজন বলেছিল, ‘আরে ভাই আগে কন্যার মুখ দেখেন গিয়ে, তারপর কাল মিষ্টিমুখ করাবেন।’ আমি কি আর তাদের কথা শুনি ।
মেয়ের মুখ যখন প্রথম দেখলাম, আহ্ কী অপার সুখ বয়ে গেল সারা শরীরে। কাউকে বোঝানো যাবে না হাজার হাজার শব্দ দিয়েও। আশপাশে মুরুব্বিদের কেউ কেউ বললেন, তুমি ভাগ্যবান। প্রথম সন্তান যাদের কন্যা হয়, তারা খুব ভাগ্যবান হয়। জীবনে উন্নতি করতে পারবে এই কন্যার ভাগ্যের কারণে। আরো এ রকম কত ধরনের ফতোয়া যে শুনতে হয়েছিল সেই মুহূর্তে। আনন্দের সময় ওগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। যতসব আজগুবি কথাবার্তা বানিয়ে বানিয়ে বলা।
এই আজগুবি কথা বলার অন্য কারণ পরে অনুধাবন করেছি। আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা, এবং কিছু ধর্মীয় অনুশাসন কন্যাদের পিছিয়ে রাখার জন্য সবসময় তৎপর। সমাজের কিছু মানুষ মনে করে কন্যা হলে কি হবে? বিয়ের পরে স্বামীর ঘরে চলে যাবে। বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে দেখার কেউ থাকবে না। আর পুত্র সন্তান হলে চাকরি বাকরি করে বাবা-মাকে খাওয়াবে পরাবে। অর্থাৎ স্বার্থপরতার বিষয়টি প্রকটভাবে দেখে আমাদের সমাজ এবং সমাজের গোড়া মানুষ।
কন্যা হলে বাবা-মার কোনো স্বার্থ হাসিল হবে না। তারা শুধু টাকা-পয়সা খরচ করে কন্যাকে বড় করবে, মানুষের মত মানুষ করবে। টাকাগুলো সব বিফলে যাবে, যখন বিয়ের পর অন্যের ঘরে চলে যাবে। হায়রে আমাদের সমাজ। হায় রে..
আমি ওসব কিছু বৃদ্ধাঙুল দেখিয়েছে।
মেয়েকে নিয়ে তখন অন্য জীবন আমার। কতক্ষণে অফিস থেকে বাসায় ফিরব, সেই আকাঙ্ক্ষা প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে ফিরত। অফিস থেকে ফিরতে যদি দেরি হয়ে যায়। কন্যা যদি ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে তো আর কন্যার মুখের সেই হাসি দেখা হবে না। কত কথা যে বলতে চাইত সেই পিচ্চি বুড়িটা। আমি শুধু অপলক তাকিয়ে দেখতাম, কি যেন বলতে চায় ও।
সব কথা অনুবাদ করলে দাঁড়াত এমন- ‘বাবা আমি পৃথিবীতে আসার পর তোমাকে অনেক মানুষ সাস্ত্বনা দিতে চেয়েছে। কন্যা সন্তান হলে অনেকে মন খারাপ করে। সে জন্য। আমি তো জানি আমার বাবা অন্য বাবাদের চেয়ে আলাদা। ওসব ফালতু ফতোয়া মোটেও কানে নেয় না।’ আরো কত্ত কি যে বলত, মুখের কষা দিয়ে লালা ঝরিয়ে ঝরিয়ে।
এর ঠিক পাঁচ বছর সাত মাস ২৪ দিন পর আরেকটি আনন্দের দিন এল। ২০০৩ সালের ২৮ মে। বুধবার। সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে বা পরে। একইভাবে, এবার সূর্য নয়, চন্দ্র তার আলো ঝরিয়ে দিল সবুজ পাতায়। তৈরি হলো অপার মুগ্ধতা। সেই আলো পাতা গলিয়ে পরার মতোই আমার দ্বিতীয় কন্যা পৃথিবীতে এলো। এবার অন্য ফতোয়া। দু-একজনের চেহারার দিকে তাকালাম। কিছুটা বিষণ্ণতা। কিন্তু মুখটা হাসি হাসি করে রেখেছে, পাছে আমি কষ্ট পাই, এই ভেবে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, আল্লাহ খুশি হয়ে যা দেন, তাতে মন খারাপ করতে হয় না। হায় কি আক্ষেপ। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।...আর নাইবা লিখি।
আমার দ্বিতীয় কন্যা আমাকে বাঁ চোখে যেন অন্যরকম আলো দান করল। প্রথম কন্যা দিয়েছিল ডান চোখে অন্যরকম আলো। আল্লাহ আমাকে যে আলো চোখে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন সেটা হলো পৃথিবীকে ভালোভাবে দেখার জন্য। আর দুই কন্যা দুই চোখে যে আলো দিয়েছিল সেই আলো আমাকে এই পৃথিবীর মানুষের পশ্চাৎপদতা, মুখে এক অন্তরে আরেক, ধর্মের অপব্যাখ্যা, কন্যাদের কিভাবে ঠকানো যায়, কিভাবে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা যায়, সামগ্রিকভাবে হঠকারীদের চেনাতে সহায়তা করতে শিখিয়েছে।
আমার আর কিছু চাই না। আল্লাহ সবাইকে সমান চোখে দেখেন, এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার দুই কন্যা আমাকে প্রতিমুহূর্তে উৎসাহ দেয় জীবনকে চেনাতে। যত দরিদ্র অবস্থায় থাকি না কেন, মান-সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ ধরে রাখা, তেলবাজি না করা, কারো কাছে করুণার পাত্র হয়ে না থাকা, কর্মমূখর জীবনকে স্যালুট করা,নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকা, কারো মাথায় আঘাত করে নিজের আখের গোছানো থেকে বিরত থাকা-এসব কাজে উৎসাহ পাই ওদের মুখপানে তাকিয়ে। একজীবনে এর চেয়ে আর বেশি কি চাওয়ার থাকতে পারে মানুষের।
দুই কন্যা লামিয়া আর সামিয়া আমার দুই চোখের আলো। কন্যা শিশু দিবসে দুজনকে আদর আর ভালোবাসা।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।