অভিমত
হাতিরঝিল, নাকি ময়লার ঝিল?
ইট-পাথরের লম্বা দেয়ালের এই শহরে শ্বাস নেওয়াই অনেক কষ্টের। বুক ভরে খোলা বাতাস পেতে রাজধানীবাসীর কতই না দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। তবুও যেন মেলে না সেই প্রাণ-ঠান্ডার বায়ু। চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই ছুটছে অনিচ্ছার গন্তব্যে, জীবিকার পেছনে। পাড়ি দিচ্ছে জনসাগর। এমন শহরে মিষ্টি-শীতল বাতাসের প্রতিশ্রুতির আওয়াজই যেন প্রাণ হিম করে দেয়। মনের অজান্তেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে কোমলতায়।
রাজধানীবাসীর প্রাণে তেমন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে ২০১৩ সালে চালু হয় হাতিরঝিল প্রকল্প। প্রায় ৩০২ একর জমির ওপর ১৬ কিলোমিটার চলার রাস্তা। ছোট-বড় মিলিয়ে আটটি সেতু ও চারটি ওভার পাস। বিশাল লেক, চক্রাকার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি ও সবুজের সমারোহ। সব মিলিয়ে তিলোত্তমা নগরীতে যেন স্বপ্নের এক গ্রাম। মানুষ-গাড়িতে ভর্তি রাস্তার নগরীতে এমন সবুজের এক সমারোহ, ভাবতেই ভালো লাগার কথা। সবাইকে স্বস্তি পাইয়ে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপারও বটে।
হাতিরঝিলের প্রতিদিনের বিকেল যেন সেই স্বপ্নের রাজ্যে চলাচলের কথাই আপনাকে মনে করিয়ে দেবে। ছুটির দিনে তো কথাই নেই। প্রতিটি ফুটপাতে শুধু পা ফেলার শব্দ। আর খানিকটা পরপর মানুষের গল্পের জটলা। সবকিছুই আড্ডাময় করে তুলত সবুজের সঙ্গে পানির মিশ্র বাতাস। কিন্তু বাস্তবতা এখন পাল্টে গেছে। সেই মনোমুগ্ধকর আবেশ তিক্ততায় চিটচিটে হয়ে গেছে। প্রশাসনের একটু সচেতনতার অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে সেই হাতিরঝিল।
২০১৩ সালের প্রথম সপ্তাহে চালুর পরের বছরই নানা অব্যবস্থাপনা ও দুর্ভোগের কথা উঠে আসতে থাকে পত্রিকার পাতায়। হতাশ হতে থাকে শহরের আনন্দপিয়াসী আটকে পড়া বাসিন্দারা। দিন দিন পত্রিকার পাতা ভরতে থাকে। জমতে থাকে নানাজনের অভিযোগ। উঠতে থাকে নানা জিজ্ঞাসা। কিন্তু কে তার উত্তর দেবে। অন্য সব প্রকল্পের মতো এটাও ভেস্তে যেতে থাকে, যা কখনই ভাবতে পারেনি ইট-পাথরকে বন্ধু করা বিশাল মনের মানুষগুলো।
সময়টা ছিল গত ২২ সেপ্টেম্বর। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির বিকেলে হাতিরঝিলের বারান্দা, ঘর ও আঙিনায় পাড়ি জমায় লাখো মানুষ। প্রিয়জনের হাত ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে দেখা যায় অনেককে। লক্ষ্য, সামান্য অবসরে একটু প্রশান্তি। প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে পানির মধ্যে গাছের ছায়ার লুকোচুরি দেখা। কিন্তু সেটা হয়তো পুরোটা পূর্ণ হচ্ছে না করোরই। হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি, নিজস্ব পরিবহন কিংবা হেঁটে চলা।
হাতিরঝিল থেকে মিষ্টি বাতাসের পরিবর্তে ভেসে আসছে একটা অপরিচিত বিকট গন্ধ। সেকেন্ডেই মন বিষিয়ে তোলার অবস্থা। স্থানটি হাতিরঝিলের বাড্ডা-মেরুল। পানিতে জমেছে পুরো ময়লার স্তর। সঙ্গে সেই ভ্যাপসা গন্ধ। একবার হেঁটে গেলেই নাভিশ্বাস ওঠে। এত গন্ধের মধ্যে মুক্ত বাতাসের চিন্তা ফিকে হয়ে ওঠে। শুটিং ক্লাব থেকে রামপুরা পর্যন্ত পুরো জায়গার অবস্থা একই। পানির দিকে তাকালে হঠাৎ বোঝার উপায় নেই, তা কী। মনে হতে পারে ময়লার ভাগাড়। যেন ময়লা পরিশোধনাগার। কিন্তু না, এটিই সেই স্বপ্নের হাতিরঝিল। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুরো ঝিলের পাড়ে জমে উঠেছে ময়লার পাহাড়। সেখান থেকে সৃষ্টি হচ্ছে পচা গন্ধের।
এই অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো বুড়িগঙ্গায় রূপ নেবে মায়ার একটি ভিন্ন শহরটি। যেখানে রয়েছে জনগণের বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। রয়েছে শত শত বিদেশি গাছ আর সুন্দর সুন্দর সব বসার স্থান। হাতিরঝিল চালু হওয়ায় খুব অল্প সময়ে যানজট থেকে মুক্তি পেয়ে কারওয়ান বাজার থেকে বাড্ডা বা গুলশান যাওয়া সম্ভব। চক্রাকার বাস আর ওয়াটার ট্যাক্সি সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু তা কি আগামীতে টিকবে এভাবে?
সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে, ১১টি স্থান দিয়ে হাতিরঝিলে ময়লা প্রবেশ করছে। সেই ময়লায় দূষিত হচ্ছে এখানকার বায়ু। দুর্ভোগে পড়ছেন মানুষ। কিন্তু এটা কি সুন্দর করা যায় না? মানুষকে একটু স্বস্তি দেওয়ার সেই প্রতিশ্রুতি কি বাস্তবায়ন করা যায় না? প্রশাসনের সুদৃষ্টি পড়লে হয়তো কয়েক দিনেই তার বাস্তবায়ন হবে।
শুধু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এই হাতিরঝিল নয়। এখানে মানুষের শান্তিময় একটি বিকেল কাটিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কয়েক পা ফেলার পরই কয়েকটি করে দোকান। অনেক জায়গা নিয়ে চেয়ার-টেবিল বসানো হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তা সংকুচিত করে সেগুলো প্রতিদিন বাড়ানো হচ্ছে। এসব খাবার দোকান হাতিরঝিলের নকশায় ছিল কি না, তা জানি না। তবে এতটা অপরিকল্পিতভাবে বিশাল অঙ্কের সুন্দর এই স্থান যে গড়ে তোলা হয়নি, এটা নিশ্চিত।
হাতিরঝিলের সৌন্দর্য রক্ষায় সাধারণ মানুষেরও অনেক কিছু করার আছে। এটাকে সুন্দর রাখতে রয়েছে অনেক দায়িত্ব। মেশিনে ছাঁটা গাছগুলো দেখে মনে আনন্দ যেমন আসে, তেমনি সুন্দরভাবে এই স্থান ব্যবহার করাও আমাদের কর্তব্য। হাতিরঝিলের ময়লা খোলা স্থানে বা পানিতে না ফেলে আমরা যেন ডাস্টবিনে রাখি। সে জন্য হাতিরঝিলজুড়ে কিছুদূর পর রাখা হয়েছে ডাস্টবিন। আমরা যেন অবশ্যই সেগুলো ব্যবহার করি। একই সঙ্গে হাতিরঝিল সুন্দর রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের ভূমিকা সবার আগে। তাদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুতই নিতে হবে। তাহলেই আমরা পাব মিষ্টি বাতাস আর হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার একট ভিন্ন আস্তানার।
লেখক : সাংবাদিক।