শরণার্থী
সন্তানের করুণ মৃত্যু মায়ের কোলে
ছোট্ট শিশু মাসুদকে বড় যত্ন করে মা হামিদা রেখেছিলেন কোলে। বুকের ধনকে বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনোরকমে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
সন্তানকে বুকে আগলে ধরে বাংলাদেশে আসতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিলেন মা হামিদা। কিন্তু সাগর পার হওয়ার সময় নিজ কোলে মারা যায় এক মাসের দুধের শিশু মাসুদ। তা জানেন না হতভাগা মা।
শিশুর মুখে বারবার চুমু খাচ্ছেন মা। ভেবেছেন, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কখনো ভাবেননি, আর কোনো দিন জেগে উঠবে না বুকের মানিক। সন্তানের পরশ মাখা আঙুল কখনো লাগবে না আর মায়ের গালে। কখনো মিটিমিটি হাসবে না ভালোবাসার ঠোঁট দুটো। দেখবে না সুন্দর পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষের সহিংসতা।
ভালোবাসার কান্নাকে মানবতার ভাষা বানিয়ে নিজে জানান দেবে না ছোট্ট শিশুটি। জানান দেবে না নিজ জন্মভূমির পরিচয় কোনটি। কাঁদবে না আর। ভাবতে কেমন জানি লাগছে। কঠিন হলেও নির্মম এ সত্য মা হামিদাকে মেনে নিতে হয়েছে, সন্তানের মুখে শেষ চুম্বনের মাধ্যমে।
কী করে সইবে মা, সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু। মানবতা কি পারবে মায়ের কোল পূরণ করতে? পারবে কি ফিরিয়ে দিতে সন্তানের হাসি? ফিরিয়ে দিতে পারবে কি জন্মভূমি?
অনাহারে থাকা মাকে আর কষ্ট দেবে না শিশুটি। দুধও খাওয়াতে হবে না তাকে। পৃথিবীর আলো দেখবে না আর সে।
নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে আসার পথে প্রাণ যায় এক মাসের শিশু মাসুদের। শিশু মাসুদের মৃতদেহ আর মায়ের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে পৃথিবী। ভারী হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র।
বিভীষিকাময় এ দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউই। মৃত সন্তানকে ভালোবাসার আঁচলে ধরে রোহিঙ্গা নারী হামিদার আকুতি দেখে চোখের পানি ধরে রাখা ছিল বড় কষ্টের। শুধু নীরবে চোখ মুছে কষ্টে পাথর হয়েছেন মা। ভুলতে পারেননি সন্তানের ভালোবাসা আর স্মৃতিগুলো।
জীবন বাঁচাতে নাফ নদে ছোট ছোট নৌকায় করে বহু রোহিঙ্গা পারাপারের চেষ্টা করে প্রায়ই। কিন্তু সাগরের ঢেউ তো জীবন বুঝে না। চলে নিজ গতিতে। তেমনি সাগরের ঢেউ ছাড়েনি মা হামিদার নৌকাকে। মাঝপথেই কেড়ে নেয় শিশুটিকে।
সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে হামিদা সন্তানকে জীবিত হিসেবে কোলে করে নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। থেমে থেমে কাঁদছেন, আদর করছেন, বুকে জড়িয়ে ধরছেন। তাঁর কান্নায় আশ্রয় শিবিরের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চোখে টলমল পানি সবার।
চোখের সামনে বুকের ধন, আদরের বাতিঘরের মৃত্যু কি পারবেন ভুলতে হতভাগা মা। বিশ্ব মানবতা কি পারবে মায়ের হাসি ফিরে দিতে? জাগ্রত হবে কি তাদের বিবেক?
নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে শিশু মাসুদের মায়ের মতো হাজারো মায়ের কোল। সত্যি পৃথিবীটা যত সুন্দর, তার থেকে বড় নিষ্ঠুর মানুষগুলো। ভালো থেকো মাসুদ। প্রার্থনা করি পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাভিশন।