‘ছোট’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বড়’ রাজনীতি
বিশ্ববিদ্যালয়কে সৃষ্টির পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হওয়ার কথা জ্ঞানচর্চা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। যে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীজুড়ে। যার দ্বারা আলোকিত হবে মানবসম্প্রদায়। সমাধান হবে সমাজের নতুন নতুন সমস্যার। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় আমরা তেমনটি দেখতে পাচ্ছি না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে ‘রাজনীতি’।
এটাকে রাজনীতি না বলে অন্যকিছু বলা যেতে পারে। সেটা ভাল কিছু নয়। কারণ, সুষ্ঠু রাজনীতি মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে। এখানে সেটা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ‘রাজনীতির’ কারণে শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি পিছিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
অনেক সময় প্রতিষ্ঠা ও কলেবরে অনেক ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় রাজনীতির দৃশ্য আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ আবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই স্বল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সবচেয়ে বেশি যা চর্চা হয়েছে তা বোধ হয় ‘রাজনীতি’।
১৯টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে জ্ঞানের চর্চা হওয়ার কথা ছিল তা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি সেই রাজনীতির একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের সামনে এসেছে। ১৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরীক্ষার বিষয়ে কথা বলেছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ভূঁইয়া। এ কারণে শিক্ষার্থীদের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাঁকে অপমানিত করেছেন, দিয়েছেন হত্যার হুমকি। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে পরে তা তুলে নিয়েছেন। শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ ‘রাজনীতির’ কারণে ওই শিক্ষককে হয়রানি করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ বলছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ২৪ ঘণ্টা। তিনি সব সময়ের জন্যই শিক্ষক। যেকোনো সময় শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। কোনো শিক্ষক যদি ১৫ আগস্টে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেন, নিজের কাজ বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সময় দেন—এটা তো খারাপ কিছু নয়। বরং ওই শিক্ষক নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যে দায়িত্ববান একজন শিক্ষক তার প্রমাণ দিয়েছেন। হ্যাঁ, তিনি যদি ১৫ আগস্টের শোক দিবসের অনুষ্ঠানে না যেতেন, তাহলে ভিন্ন কথা ছিল। তিনি তো সেটা করেননি।
দীর্ঘদিন ধরেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সমস্যার বিষয় গণমাধ্যমে আসছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলনের কারণে অনেক দিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এতে করে পিছিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীরা, পড়েছেন সেশনজট নামের এক ভয়াল থাবায়। যা থেকে বের হওয়ার রাস্তা শিক্ষার্থীদের হাতে নেই। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখার খবর কয়েক দিন পর পরই গণমাধ্যমে আসছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার বদলে এখন নানামুখি রাজনীতি বেশি হচ্ছে বলে মনে হয়। যা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘রাজনীতির’ নানা রূপ আমাদের সামনে এসেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়ার সময়ে সবচেয়ে খারাপ চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে। ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন পক্ষের টানা আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ দিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল। যার কুফল এখনো ভোগ করছেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা পায় বেগর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় চিন্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স খুব বেশি দিন নয়। ক্যাম্পাসের অবকাঠামো বা সুযোগ-সুবিধাও তেমন বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু আমরা দেখছি, সেখানে সব চেয়ে বেশি যা হচ্ছে তা ‘রাজনীতি’। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল জলিল মিয়া কারাগারে গেছেন। যা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ‘রাজনীতির’ একটি প্রভাব বলেই অনেকে মনে করেন। দুর্নীতির অভিযোগে একজন উপাচার্য জেলে যাবেন এটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। তাহলে অন্য শিক্ষককের কী অবস্থা সেটা বোঝার জন্য নিশ্চয় কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে ভর্তি হয়ে এখনো তৃতীয় বর্ষ শেষ করতে পারেননি অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অথচ তাঁদের এখন মাস্টার্সে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সেশনজটের কারণে সেখানকার শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ঝড়ে গেছে কয়েকটি বছর। আগামীতে হয়তো আরো যাবে। এটা শুধু শিক্ষকদের গাফিলতি ও ‘রাজনীতির’ কারণে হচ্ছে।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য দায়িত্ব শেষ করে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যারয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় যেন তিনি সেখানকার শিক্ষা-গবেষণাসহ সামগ্রিক পরিবেশের উন্নতি করতে পারেন। কিন্তু এখন বোধহয় সেই চিত্রটি খানিকটা ম্লান হয়ে গেছে। উপাচার্য পদটি পেতে এখন নানা অপরাজনীতি করতে দেখা যাচ্ছে শিক্ষকদের। এর কারণ কি ওই নয় শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া? সেটাই যদি মূল লক্ষ্য হয় তাহলে আগামী দিনে গোটা জাতি জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়বে। যা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
কুমিল্লা বা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ যদি ফিরে না আনা যায়, তাহলে আগামী দিনে এর ফল রাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে। গবেষণার মান বাড়ানোর জন্য সেখানকার শিক্ষকদেরই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দিকে এখনই নজর দিতে হবে। না হলে, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টাতে থাকবে। আশা করছি, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় দুটিসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে।
লেখক : সাংবাদিক