বন্যা
দুর্গতের দুর্গতি কতটা বুঝি?
এ দেশে স্বাভাবিক বিষয়কেও অস্বাভাবিক রূপদান চলে হরহামেশা। চিকুনগুনিয়া মহামারি রূপ নিয়েছে কি নেয়নি তা নিয়ে রীতিমতো বাকযুদ্ধে লিপ্ত হন ঢাকার নগরপিতা আর বিশেষজ্ঞরা। যেন কী পরিস্থিতি হলে মহামারি বলা যায় তার কোনো মাপকাঠি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মহামারি হোক আর যাই হোক সেটা নিয়ন্ত্রণের চেয়েও যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল এর স্বীকৃতি দেওয়া বা আদায় করা। একইভাবে বলা যায় হাওরের বিপর্যয়ের কথাও। সে সময়ও দেখি হাওর এলাকাকে দুর্গত বলবে কি বলবে না এ নিয়ে বিস্তর কথা চালাচালি।
গত সপ্তাহের শুক্রবার থেকে উজানের ঢলে উত্তরের মানুষের যে দুর্গতি শুরু হয়েছে তাকেও এইরকম একটা স্বীকৃতির আওতায় আনতে এরই মধ্যে দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকদিন আগে দিনাজপুরে বন্যাদুর্গতদের দেখতে যান এবং সরকারের কাছে দাবি জানান দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে যেন দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
খুবই জনবান্ধব দাবি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ দুর্গত এলাকা ঘোষণা করলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের সেবাদানে সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।
কিন্তু আমার কথা হলো, বাংলাদেশে এই দাবি কেন করতে হয়? সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখি প্রায়ই এই দাবি উঠে আর সরকার তা অস্বীকার করে। দুর্গত ঘোষণা করলে সরকারের কী ক্ষতি আর না করলে কী লাভ এই প্রশ্ন আমার মাথায় কিলবিল করে। এরমধ্যে রাজনীতির লাভ-ক্ষতির কোনো হিসাব আছে কি না তাও আমি বুঝতে পারি না। হয়তো আছে, হয়তো নেই। তবে আমার কেবলই মনে হয় সরকারকে আরেকটু আন্তরিকই হওয়া উচিত।
যদি এমন হয় যে পরিস্থিতি দুর্গত এলাকা ঘোষণার মতো নয় কিন্তু কাছাকাছি, তাহলেও সরকার যেন ঘোষণাটা দিয়েই দেয়। এতে যদি দুর্গত মানুষেরা কিছুটা বাড়তি সুবিধা পায়, পেলই বা। কী আসে যায়। যে মানুষগুলো বানের তোড়ে ভেসে তাদের ঘর ছেড়েছে তাদের কষ্টের কাছে আমাদের এই ঘোষণা দানের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়?
কী কষ্ট তাদের নারীদের, শিশুদের, বৃদ্ধদের- সেই খবর কি যথার্থভাবে আমরা রাখি বা পাই? কতটা বুঝি আমরা দুর্গত মানুষের দুঃখ? গত সপ্তাহের রোববার যখন দিনাজপুরের আত্রাই নদীর শহররক্ষা বাঁধের ভাঙনের খবর আসে আমাদের কাছে, বুকটা হুহু করে ওঠে। আহারে, এই এতগুলো মানুষ হুট করে কীভাবে কী করবে? বাঁধভাঙা পানি কোনো অংশেই সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে কম নয়। কাছাকাছি যাদের ঘরবাড়ি তাদের নিশ্চয়ই সমুদ্র উপকূলের মানুষের মতো অভিজ্ঞতা হবে। তাদের ঘরে যে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছিল, খেলছিল মনের আনন্দে তারা কী করে এই পানি মাড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবে? সত্যিকার অর্থে যেতেও পারেনি।
দিনাজপুরে গত রোববারই সর্বনাশা এই বন্যার পানিতে ডুবে মারাগেছে ৪ শিশু। মারা গেছে বয়স্ক নারী-পুরুষও। একদিনে সেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৩ জন। এরমধ্যে কাউকে কাউকে দংশন করেছে পানির তোড়েই দিশেহারা সাপ। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও মারা গেছে কেউ কেউ।
এমন পরিস্থিতিতে যারা পড়েন তাদের জীবনটা তখন আর যাই হোক স্বাভাবিক থাকে না। তাদের খাওয়ার ঠিক থাকে না, থাকার জায়গা থাকে না, পরনের বস্ত্র থাকে না। রাস্তায় বা স্কুলে যেখানেই ঠাঁই হোক না কেন সেটি যে তার নিজের ঘর নয়, নিজের বিছানা নয়- এই কষ্টটুকুও কি কম?
পত্রিকায় দিনাজপুরের এক এনজিও কর্মকর্তার কথা জানলাম। “বউ বাচ্চা নিয়ে তাঁর চারজনের সংসার। তাঁর ওপরেই সবাই নির্ভর। বানের পানি তাঁর ঘরটা প্রায় পুরোটাই ডুবিয়ে দিয়েছে। কোনো রকমে এককাপড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তায়। সেখানে ছাউনির তলে চলছে উদ্বাস্তু জীবনের হিসাব-নিকাশ। দুঃখের কথা বলতে বলতে দুচোখ তাঁর আর্দ্র হয়ে ওঠে। স্ত্রী আর বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না তিনি। সবচেয়ে পোড়াচ্ছে এই বিষয়টা যে, তাঁর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই!” এই খবর পড়ি আর ভাবি, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই- এমন লোকের সংখ্যা দিনাজপুরে কত? কুড়িগ্রামে কত? জামালপুরে কত? এসব মানুষের সবার দুঃখের রং কি ওই এনজিও কর্মকর্তার মতো নয়? আর একজন চাকরিজীবীর যদি এই দশা হয়, দিনমজুর বা কর্মহীনদের কী দশা? যাদের কোনো অভিবভাবক নেই বা এতিম- তাদের কী অবস্থা? যে রিকশা চালিয়ে খেত, তার রিকশা চালানোর উপায় নেই, কারণ রাস্তা ডুবে গেছে। সে কীভাবে চালাবে সংসার? এক বন্যা, প্রশ্ন অনেক। কথা হলো, এই প্রশ্নগুলো আমাদের এবং আমাদের সরকারের মনে উদয় হয় কি না।
যাদের খুব সামর্থ্যবান আত্মীয়স্বজন আছে তারা হয়তো কিছুটা কম কষ্ট ভোগ করবে। এক কাপড়ে গিয়ে আশ্রয় নেবে নিকটজনের কাছে। লজ্জ্বা শরম ভুলে কিছুদিন বেশিও থাকবে। কিন্তু কয়জনের আছে এমন নিকটজন? যাদের নেই, তাদের কিছুই নেই। টিভিতে তাদের পরিস্থিতি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। কেউ কোমর সমান পানি আর কেউ বা গলা পানি বেয়ে ঘরের এতটুকু আসবাব নিয়ে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কেউ তার আদরের সন্তানকে বুকে আগলে ধরে কাঁপছে আর বলছে- ‘ভাই আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে, আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।’ এক বৃদ্ধকে দেখলাম, খবরেই, হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁর ঘর বলতে আর কিছু নেই। বানের ¯শুরুতে ভেসে গেছে। তার দুটি গরু আছে। সে দুটি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে একটি বাঁধে। এক নারীকে দেখলাম এক ঝাঁক ছাগল নৌকায় করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বলছিলেন- ‘ভাই এই অবুঝ প্রাণিগুলার লাইগে মায়া লাগে, কী করুম, তারপরও চিন্তা করছি বেচি দিমু।’
উত্তরাঞ্চলজুড়ে এখন এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুঃখ আর দুঃখ। লাখ লাখ ঘরহারা মানুষ। কারো মুখে হাসি নেই। সেখানকার একেকটি মলিন মুখ এখন চেয়ে আছে সরকারের দিকে। সামর্থ্যবান মানুষের দিকে। তাদের খাদ্য দরকার, আশ্রয় দরকার। সরকার যদি মনে করে, আন্তরিকভাবে ইচ্ছে পোষণ করে- আমি মনে করি এই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে। সেটা সরকার দুর্গত এলাকা ঘোষণা করেই তাদের পাশে দাঁড়াক বা না করেই দাঁড়াক। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যেন দুর্গতদের দুর্গতিটা ঠিকঠাক বোঝেন, উপলব্ধি করেন। তাদের কষ্টের সব রং না হোক কিছু হলেও যেন দেখেন, বোঝেন। কারণ তাদের সুমতি না হলে আসলে সামগ্রিক এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি কোনোভাবেই সামলানো যাবে না।
এরপরও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়েও অনেক কিছু করার আছে। দুর্যোগ বড় হলে সরকারের একার পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন। এমনকি এই দায়িত্ব সরকারের একারও নয়। সামর্থ্যবান প্রতিটি নাগরিকের তার দেশের অন্য নাগরিকের দুঃখের সময় পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব।
আমরা বানভাসীদের কষ্ট বুঝতে পারছি না, না হয় আমরা আন্তরিক নই। একইভাবে দেশের আরেক প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তি নেতাকর্মীদের ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। কেবল ঘোষণা আর নির্দেশেই সব আটকে আছে।
আশাকরি দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে বন্যাপীড়িতদের পাশে দাঁড়াবে। কারণ
বন্যাপীড়িত মানুষেরা বড় অসহায় ।
লেখক : জ্যেষ্ঠ বার্তাকক্ষ সম্পাদক, আরটিভি